সাল ১৯০৬। শহর ভিয়েনা। ওই শহরে এক বড় ব্যবসায়ীর ষোড়শী মেয়ে ছিল। একদিন রাস্তার ধারে বসে থাকা এক আর্টিস্টকে দিয়ে শখ করে মেয়েটি তার পোট্রেট আঁকাল। অসম্ভব রূপবতী এই তরুণীর ছবি আঁকতে গিয়ে মনের অজান্তে শিল্পী তার প্রেমে পড়ে গেল। শিল্পীর বয়সও বেশি না । মাত্র আঠার। ছেলেটির স্বপ্ন চিত্রশিল্পী হওয়া। Academy of Fine Arts Vienna-তে চেষ্টা করেছিল ভর্তি হবার জন্য। কিন্তু পারেনি। তখন লুবনিগ নামে আরেকটি শহরে একটি মিউজিয়াম ছিল। সেখানে সেই শিল্পীকে গরীব বলে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। ছেলেটির অবসর কাটে রাস্তার ধারে ছবি এঁকে। আবার মাঝে মাঝে পথচারীদের পোর্টেট এঁকে দুচার পয়সা রোজগার করে। শিল্পীদের মন অনেক রোম্যান্টিক হয়। এটাই স্বাভাবিক। তো পরদিন মেয়েটিকে সে প্রপোজ করে।
মেয়েটি হা বা না, কিছুই বলে না। ছেলেটি মাঝে মাঝে মেয়েটির বাড়ির সামনে গিয়ে বসে থাকত। একপলক দেখার জন্য। বিশাল বাড়িটি উচু প্রাচীরে ঘেরা। বিশাল লোহার গেট। মাঝে মাঝে ছেলেটি তার একমাত্র সঙ্গী কুকুরকে গেটের ফাঁক দিয়ে প্রবেশ করিয়ে দিত বাড়ির ভিতরে। কুকুরটির মুখে থাকত প্রেমপত্র। কুকুরটি ছিল ছেলেটির অনেক প্রিয়।
ভিয়েনা আসার সময় তার মা এই কুকুরটিকে তার সাথে দিয়েছিল। বলা যায়, কুকুরটি ছিল মায়ের দেওয়া শেষ উপহার। একদিন ছেলেটি জানতে পারে তার মাও মারা গিয়েছেন। ছেলেটির আর কেউ রইল না। এদিকে মেয়েটির পরিবার ছেলেটির বিষয়টি আমলে নিল। ছেলেটি চালচুলোহীন, রাস্তার ছেলে। তার ওপরে non-Jewish এই সম্পর্ক কিছুতেই সম্ভব নয়। আর ছেলেটির ভবিষ্যত বলে কিছু নেই। পার্কে বসে মাঝে মাঝে বাদাম খেত আর ভাবত সে বা তার মতো লোকই তো বেশি, তবে তারা চালচুলোহীন কেন, নিপীড়িত কেন? তো, ওই বড়লোক তরুণীর পরিবারের সদস্যরা শিল্পীকে বারবার বারণ করে দিল। কিন্তু প্রেম কি আর বারণ শোনে? ছেলেটি সুযোগ পেলেই মেয়েটিকে দূর থেকে দেখত। উত্তর না এলেও প্রেমপত্র দিত। তো একদিন প্রেমপত্রসমেত কুকুরটিকে আবার পাঠাল মেয়েটির বাড়িতে। কিন্তু এইদিন আর কুকুরটি ফিরে এলো না। ছেলেটি সারারাত অপেক্ষা করে, সকালে চলে গেল। পরদিন আবার মেয়েটির বাড়ির সামনে গেল। বাড়ির সামনে রাস্তার পাশে ছেলেটি তার সেই প্রিয় কুকুরটির মৃতদেহ খুঁজে পেল। মা নেই, একমাত্র সঙ্গী কুকুরও নেই। নির্মমভাবে তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। সেইদিন কাঁদতে কাঁদতে ছেলেটি চলে এলো। আর কোনোদিন ওই বাড়ির সামনে যায়নি সে।
মেয়েটি ছিল ইহুদী পরিবারের, তাই হয়তো পরবর্তীতে ছেলেটি অনেক ইহুদিদের হত্যা ও অত্যাচার করে। ছেলেটির নাম ছিল এডলফ হিটলার। তার লেখা বই ‘মেইনক্যাম্প’ যারা পড়েছেন তারা নিশ্চয়ই এক জায়গায় পড়েছেন যে, তার মাঝে মাঝে মনে হতো এই জগতে কিছুই কিছু না। কিছুই নেই। এই পরাক্রমশালী, ফ্যাসিস্ট হিটলারের এই শৈশব, এই বেড়ে ওঠাকে আমি ইগনোর করতে পারি না। মাইকেল মধুসূদন রাবণকে বীর হিসেবে দেখিয়েছিলেন। হিটলারকে কেউ দেখায়নি। কিন্তু জাতীয়তাবাদ তো যখন ধর্মে রূপান্তরিত হয় তখন উগ্রই হয়। নাকি? তবু জাতীয়তাবাদী সত্তার ইতিহাসবিদরাও তাকে খল নায়কই বানিয়ে রাখলেন। যেমন রেখেছে আমেরিকা, লেনিনকে। লেনিনের মূর্তি ভাঙার পর আহমদ ছফা একটি কবিতা লিখেছিলেন আক্ষেপ করে—“লেনিন এবার ঘুমাবে শান্তিতে।”
কিন্তু লেনিনের অনুসারীরা কি দেশে দেশে ঘুমাচ্ছে শান্তিতে? বা হিটলারের অনুসারীরা? দুই ধারা, দুটি বড় প্রোফাইল। লেনিনের ভাইকে জার শাসকরা মেরে ফেলেছিল। ওই ভাই-হত্যার প্রতিশোধ কাজ করেছিল লেনিনের বিপ্লবী হয়ে ওঠার পেছনে। কার্ল মার্কসের স্বপ্ন বাস্তবায়নে জাতীয়তাবাদী না আন্তর্জাতিকতাবাদী হয়ে উঠেছিলেন। যৌথ মানব খামারের স্বপ্ন প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। এ মাসে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে তার নেতৃত্বে বলশেভিকরা অক্টোবর বিপ্লব করেছিল। এরপর ওই বিপ্লব ছড়িয়ে পড়েছিল পূর্ব ইউরোপে। বিভিন্ন দেশে। দুই বিপরীত রাজনৈতিক দর্শনের অনুসারী দুইজন। দেশে দেশে এখনো এই দুই দর্শনের অনুসারীরা লড়ছেন। এও আমরা জানি। তবে জাতীয়তাবাদী প্যাকেজ নাকি প্রাক্সিস প্যাকেজ আপনার দরকার সেটি আপনিই জানেন। আমার দরকার পরেরটা। আপনার? হিটলারের মৃত্যুর খবরটি কিভাবে জেনেছিলেন তার দ্বারা নির্যাতিত কার্ল লেহমান? ১৯৪৫ সালের ১ মে। লন্ডন থেকে ৬৫ কিলোমিটার দূরের বিবিসির রিডিংয়ে নিজের ডেস্কে বসে কাজ করছিলেন কার্ল লেহম্যান।
আরো পড়ুন ➥ শীতে পাওয়া সাহিত্য
সোভিয়েত সেনাবাহিনী বার্লিনের উপকণ্ঠে পৌঁছে গেছে আর জার্মানির সঙ্গে যুদ্ধও শেষ পর্যায়ে এসে ঠেকেছে।
২৪ বছর বয়সী লেহম্যান রেডিও শুনছিলেন। এ সময় একটি ঘোষণা এলো, শ্রোতাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ শোনার জন্য প্রস্তুতি নিতে বলা হচ্ছে। তারা একটি আনুষ্ঠানিক সংগীত বাজিয়ে ঘোষণা দিল, হিটলার মারা গেছেন। সেদিনের সেই ঘোষণাটি মনে করছেন লেহম্যান, তিনি জানান, বলশেভিকদের সঙ্গে লড়াইয়ের সময় তিনি মারা গেছেন। খুবই ভারী কণ্ঠে ওই ঘোষণাটি দেওয়া হয়েছিল। ইহুদিদের ওপর নাৎসি বাহিনীর নির্যাতন বেড়ে যাওয়ায় নয় বছর আগে লেহম্যান ও তার ছোট ভাই গেয়গকে জার্মানি থেকে ব্রিটেনে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তাদের বাবা-মা। তাদের বাবা ছিলেন একজন জার্মান ইহুদি। লেহম্যান বলেন, ‘আমি একেবারে স্বস্তি অনুভব করছিলাম, কারণ হিটলার আমার জীবনটা ধ্বংস করে দিয়েছে।” কিন্তু পরে জানেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির নিশ্চিত পরাজয় বুঝতে পেরে ১৯৪৫ সালে বার্লিনের একটি বাঙ্কারে গুলি করে আত্মহত্যা করেছিলেন অ্যাডলফ হিটলার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর এমনই জেনে আসছে বিশ্ববাসী। কিন্তু এই সুইসাইডের ঘটনা কতখানি ঠিক? প্রশ্ন তুলেছেন সিমোনি রিনি গুয়েরিরো। তার বইয়ের নাম, ‘হিটলার ইন ব্রাজিল-হিজ লাইফ অ্যান্ড হিজ ডে’। বইতে সিমোনি দাবি করেন, হিটলার ছদ্মবেশে পালিয়ে যান প্রথমে আর্জেন্টিনা, পরে প্যারাগুয়ে, আরো পরে বলিভিয়ায়। তারপর? ১৯৮৪ সালে বলিভিয়ার জঙ্গলে মারা যান গুলি খেয়ে। বলিভিয়ার জঙ্গলে হিটলারের মতো একনায়কতান্ত্রিক মারা যাওয়ার খবরে আসরা নড়েচড়ে বসি। কেননা, বলিভিয়ার জঙ্গলে বিপ্লবী চে গুয়েভারা মারা যান। চে-কে নিয়ে পরে বলি। এর আগে হিটলারের ভক্ত এক অধ্যাপকের কথা মনে পড়ছে। অ্যানাটমি বইয়ে সাধারণত মানবদেহের চামড়া, পেশি, শিরা-উপশিরা, স্নায়ু, দেহের ভেতরের বিভিন্ন অঙ্গ ও হাড় চিত্রের সাহায্যে বিস্তারিতভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়। অপারেশনের সময় অনেক সার্জনের কাছেই জরুরি হয়ে ওঠে এ ধরনের একটি অ্যানাটমি বই। ‘পার্নকপ্ফ টোপোগ্রাফিক অ্যানাটমি অব ম্যান’ এনাটমির একটি সেরা বই। লেখকের নাম পার্নকপ্ফ। এই বইয়ের পেছনে রয়েছে রক্তাক্ত করুণ ইতিহাস।
নাৎসিদের হাতে নিহত ব্যক্তিদের দেহ ব্যবচ্ছেদ করে গবেষণালব্ধ ফল সন্নিবেশিত হয়েছে এ বইয়ের পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা। হাতে আঁকা জটিল সব চিত্রসংবলিত এই বইয়ে রয়েছে মানবদেহের বিস্তারিত খুঁটিনাটি। কিন্তু পার্নকপফের বইটি এখন আর বাজারে নেই। তাই কয়েক খণ্ডে প্রকাশিত এই বইয়ের পুরনো একটি সেটও যে কোনো সার্জনের কাছে মহামূল্যবান। হাজার হাজার পাউন্ড খরচ করেও এটি সংগ্রহে রাখতে দ্বিধা করেন না আগ্রহীরা। চড়া মূল্যের এই বই কেউ কেউ সাজিয়ে রাখেন ক্লিনিকে কিংবা বাড়ির লাইব্রেরিতে।
সমালোচকেরা মনে করেন, বইটির যেহেতু কালো ও মর্মান্তিক এক ইতিহাস রয়েছে, তাই এটি ব্যবহারের প্রসঙ্গে নৈতিকতার প্রশ্ন জড়িত। নাৎসিবাদী খ্যাতিমান ডাক্তার এডুয়ার্ড পার্নকপফের ২০ বছর মেয়াদি একটি প্রকল্প ছিল এই অ্যানাটমি বই। সহকর্মীদের ভাষ্যানুযায়ী, পার্নকপ্ফ ছিলেন নাৎসিবাদের উগ্র সমর্থক। হিটলারের ভক্ত। কর্মস্থলে তিনি রোজ নাৎসি ইউনিফর্ম পরে যেতেন। তাকে যখন ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল স্কুলের ডিন পদে নিয়োগ দেওয়া হয়, তখন তিনি সব ইহুদি সহকর্মীকে বরখাস্ত করেন। বরখাস্ত হওয়া কর্মীদের মধ্যে ছিলেন তিন জন নোবেল বিজয়ীও। ১৯৩৯ সালে নতুন একটি আইন প্রণয়ন করে বলা হয়, বন্দীদের হত্যা করার পরপরই গবেষণা ও শিক্ষার কাজের জন্য তাদের দেহগুলোকে নিকটস্থ অ্যানাটমি বিভাগে জমা দিতে হবে। সেই সময়ে ড. পার্নকপ্ফ দিনে ১৮ ঘণ্টা করে কাজ করতেন। মৃতদেহগুলো একের পর এক ব্যবচ্ছেদ করতেন। সেই সময়ে তার সঙ্গে থাকতেন একদল আঁকিয়ে, যারা সেগুলো আঁকতেন। মৃতদেহ দিয়ে অ্যানাটমি বিভাগগুলো কখনো কখনো উপচে উঠত। বিভাগগুলোতে আর মৃতদেহের স্থান সংকুলান না হলে তখন কখনো কখনো বন্দীশিবিরগুলোতে হত্যাকাণ্ড সাময়িকভাবে স্থগিত করা হতো।
আরো পড়ুন ➥ স্মরণীয় ১০ জন যারা পেয়েছিলেন রাষ্ট্রের অবমাননা ও অবিচার
পার্নকাপফের বইয়ে যে ৮০০ চিত্র রয়েছে, তার অন্তত অর্ধেকই এসেছে রাজনৈতিক বন্দীদের থেকে। এসব বন্দীর তালিকায় সমকামী নারী-পুরুষ, জিপসি, রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বী ব্যক্তি ও ইহুদিরা ছিল। এটলাস থেকে বইয়ের প্রথম খণ্ডটি প্রকাশিত হয় ১৯৩৭ সালে। বইটিতে ইলাস্ট্রেটর হিসেবে এরিখ লেপিয়ের ও কার্ল এন্ডট্রেসের স্বাক্ষর ও স্বস্তিকা চিহ্ন রয়েছে।
লেনিন বা চে গুয়েভারার জীবনটা ছিল অন্যরকম। লেনিনকে নিয়ে লিখে বিখ্যাত হয়েছেন মিখাইল জেরানভ। বইয়ের নাম, ‘লেনিন, ড্রিমার অব রেভ্যুলেশন’। এ বইয়ের কিছু অংশ: “ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানিভ (লেলিন) ১৮৭০ সালের ২২ এপ্রিল জার শাসিত তৎকালীন রাশিয়ায় সিমর্স্ক শহরে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা ল্যা নিকোলয়েভিচ উলিনায়ভ ছিলেন একজন বিদ্যালয় পরিদর্শক আর মা মারিয়া আলেক্সন্ড্রাভনা ছিলেন শিক্ষিকা। ছয় ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। পুলিশের হাত থেকে বাঁচার জন্য সাইবেরিয়ার ‘লেনা’ নদীর নামানুসারে তিনি নিজের ছদ্মনাম রাখেন লেলিন। মজার ব্যাপার হলো লেলিন ছাত্র বয়স থেকেই মার্কসবাদী হলেও তার বাবা ছিলেন একজন কট্টর গণতন্ত্রবাদী। বড়ভাই আলেকজান্ডার ও বোন অ্যানা ইলিচনিনা ছিলেন বিপ্লবী ও সহযোদ্ধা। ১৮৮৬ সালে বাবা মারা যাওয়ার পর সংসারের দায়িত্ব এসে পড়ে মায়ের ওপর। এদিকে বাবা মারা যাওয়ার কিছুদিন পর একই বছরে লেলিনের পরিবারে আসে ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন। বড়ভাই আলেকজান্ডার ছিলেন ‘নারোদনায়া ভোলিয়ার’ নামের একটি বিপ্লবী সংগঠনের সভ্য। এই সংগঠন সিদ্ধান্ত নেয় তৃতীয় জারকে হত্যা করা হবে। গুপ্তচররা বিষয়টা জেনে ফেলে। চার সঙ্গীসহ আলেজজান্ডারকে ফাঁসি দেওয়া হয়। তখন লেলিনের বয়স ছিল ১৭ বছর। বড়ভাইয়ের ফাঁসির বিষয়টি তাকে ভয়াবহভাবে নাড়া দেয়। বড় ভাইয়ের প্রভাব পরবর্তী জীবনেও ছিল উল্লেখযোগ্য মাত্রায়। ১৮৯৫ সালে লেলিন কারারুদ্ধ হন এবং ১৮৯৭ সালে তাকে পূর্ব সাইবেরিয়ার নির্জন স্থানে নির্বাসিত করা হয়। এর কিছুদিন পর ক্রুপস্কায়াকেও সেখানে নির্বাসনে পাঠায়। পরবর্তীকালে (১৮৯৮) তারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। নির্বাসনে লেলিন ৩০টি বই রচনা করেন। লেনিন গল্পকার ছিলেন। একটি মাত্র বই লিখেছিলেন। বইয়ের নাম, ‘সেকেন্ড আলেকজান্ডার’।”
সেকেন্ড আলেকজান্ডার গল্পে আমার দেখি, গল্পের শুরু হয়েছে এভাবে, “পাহাড়ের খাদের কয়েকটি খাদ স্কিপিং করার মতোন লাফিয়ে সরু থেকে বড় খাদে দাঁড়াল সেকেন্ড আলেকজান্ডার। বাইনোকুলারে চোখ রেখে দেখে নিল চারপাশ। ওভারস্যাকে থিসিসটা, বিপ্লবের। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। সেকেন্ড আলেকজান্ডার ফের বাইনোকুলারে চোখ রাখল। তাঁবুতে ফিরবে সে। ওখানে ঘুমানোর আগে অব্দি ভদকা খাবে ফায়ারপ্লেসের সামনে বসে। তখন নির্ঘাত আন্না বলবে, ‘এত মদ গিলছো কেন?’ সেকেন্ড আলেকজান্ডার বলবে না নিশ্চিত তার ভাইকে যেদিন শাসকরা ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিল সেইরাতের কথা। সারারাত ছটফট। বারবার ভাইয়ের মুখ। ফাঁসির রজ্জু। একটা শহরে, একটা রাষ্ট্রে ঘটে যাচ্ছে যখন এসব তখন সবাই ঘুমাচ্ছিল।”
আরো পড়ুন ➥ বিখ্যাত সৃষ্টিশীলদের অবসাদ ও স্যাটায়ার
এই ‘দ্বিতীয় আলেকজান্ডার’ যে লেনিন এটি নিশ্চয়ই না বোঝার কথা না। মৃত লেনিনকে এখনো আমেরিকা ভয় পায়। সত্যি বলছি। আমাদের জাহিদ হায়দারের গল্প ‘লেনিনের বেঁচে থাকা’-তে এই অংশটুকু পড়ুন তবে, “ব্রজনাথপুর গ্রামের লেনিন ছিল ভালো ছাত্র। পাবনা এডোয়ার্ড কলেজ থেকে মানবিক শাখায় আইএ পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছিল সমাজবিজ্ঞানে। এমএ পরীক্ষায় পেয়েছিল প্রথম শ্রেণি, তবে পজিশন ছিল দ্বিতীয়। করিমুল্লাহ ভাবত, রাশিয়ার লেনিনের মতো তার ছেলে করবে রাজনীতি, সমাজতন্ত্র আনবে দেশে, হবে শেখ মুজিবের মতো বড় নেতা। বাপ করিমুল্লাহর মাথায় এই স্বপ্ন আসার একটা কারণ হতে পারে, সম্পদের অধিকার নিয়ে কমিউনিস্ট নেত্রীর বক্তৃতা এবং সলিলদার কাছে শোনা চারু মজুমদারের নকশাল আন্দোলনের মূলকথা। কিন্তু ছেলে লেনিন বাপের স্বপ্নের ধার দিয়েও যায়নি। লেনিনের পছন্দ শিক্ষকতার চাকরি। যোগ দিল একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। দু বছর চাকরি করার পর পেয়ে যায় বিদেশে পড়ার সুযোগ। লেনিনের বিদেশ যাওয়া উপলক্ষে ব্রজনাথপুর গ্রামের বাড়িতে মিলাদ হলো। মিলাদ পড়ালেন গ্রামের মসজিদের ইমাম সাহেব। মিলাদ শেষে তিনি লেনিনকে আলাদা ডেকে নিয়ে, প্রায় ফিসফিস স্বরে বললেন, ‘বাবা নাছারার দেশে যাচ্ছো সাবধানে থাইকো, মেয়েগুলি খুব শয়তান, সবসময় আল্লাহর নাম লিবে, নামাজ কাজা ক্যরে না।’ লেনিন মনোযোগ দিয়ে কথা শুনে মিলাদ পড়ানোর জন্য টাকা দিল ইমাম সাহেবকে। তিনি টাকা গুনে দেখলেন, তিনশ। ‘যাচ্ছো আমেরিকায় আর একশ দিলি ভালো হয়।’ ইমাম সাহেবের চাওয়াকে পূরণ করে লেনিন।
আগে অনেক চিঠি পাবনা থেকে গেছে আমেরিকার হাওয়াইতে, এসেছে অনেক উত্তর। প্রেরক ছিলেন মুহম্মদ করিমুল্লাহ; প্রাপক, মুহম্মদ নিজামউদ্দিন। আমেরিকার উদ্দেশে যাওয়ার আগের দিন সন্ধ্যায় লেনিন বাবাকে তার আমেরিকার ঠিকানা লিখে দেয়। নামের সঙ্গে লেখেনি লেনিন। করিমুল্লাহ, কেন নামের সঙ্গে লেনিন নেই, ছেলের কাছে জানতে চাইলে লেনিন বলল, আমেরিকানরা লেনিন নামের মানুষকে পছন্দ করে না।”
লেনিনকে ভয় পেলেও চে গুয়েভারাকে ভয় পায় না আমেরিকা। কারণ? চে-র ছবি সম্বলিত টি-শার্ট, ব্রেসলেট, ক্যাপ ব্যাগ এসব যেন এখন তার চিন্তার বিরোধীদেরও এক ফ্যাশনের অংশ। আমি এক উগ্র মৌলবাদী দলের ছেলের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ‘যার ছবি আপনার কালো টি শার্টে আঁকা (চে-র ছবি ছিল, বহুল পরিচিত সিগারেট টানা অবস্থার চে) তিনি কে ? বিশ্বাস হবে না জানি, তবু বলি ওই ছেলে বলেছিল, ‘হবে কোনো গায়ক বা মডেলের।’ চে-র আলাপ বারান্তরে হবে।