আদি মৃত্তিকার সন্তান

, শিল্প-সাহিত্য

মোহিত কামাল | 2023-08-31 22:35:26

 

দক্ষিণ ভারতের বেঙ্গালুরুর মূল সড়কে ওঠার পর চালক সুন্দর উচ্চারণে বাংলায় জিজ্ঞেস করল ‘এবারই প্রথম এলেন ইন্ডিয়ায়?’

‘হ্যাঁ। এবারই প্রথম।’ উত্তর দিয়ে দুপাশে তাকাতে লাগল ট্যাক্সির পেছনে বসা মনীশ মাহিন।

চালকের আচমকা প্রশ্নে ঘোরের জগৎ থেকে চমকে উঠলেও উত্তর দিতে দেরি করেনি সে। প্রথমে ভেবেছিল এই চালক ইশারায় কথা বলে, মুখ ফুটে কথা বলে না। বিমান থেকে নেমে ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে এসে নিমহ্যান্সের কার্ড ধরিয়ে বলেছিল, ‘দিস ইজ মাই ডেস্টিনেশন’। ইংরেজি বলার কারণ এদেশে বহু ভাষার মধ্যে হিন্দির দাপটে হিন্দি ভাষায় কথা বলে সবাই। আর বোম্বে সিনেমার কারণে নিজে হিন্দি বুঝতে পারলেও বলতে অসুবিধে হয়, বলতেই পারে না মনীশ।

প্রথম থেকেই চালক কোনো কথা বলেনি। মালপত্র ট্যাক্সিতে তুলে মিটারের হ্যান্ডেলটা এক ঝটকায় খুলে স্টার্ট দিয়ে প্রায় ত্রিশ মিনিট চলার পর সামনের দিকে তাকিয়েই বাংলায় প্রশ্ন করেছিল চালক। সে-কারণে চমক খেলেও, বেশিক্ষণ চমকিত থাকতে পারল না। রাস্তার দুপাশে সাইনবোর্ডে যতই দেখছে, ততই হতবাকই হচ্ছে না কেবল, বিস্ময়ও জাগছে। হিন্দি বর্ণমালা পড়তে না পারলেও হিন্দির ভাষার ছড়াছড়ি দেখে শনাক্ত করতে পারছে না কোথায় এসে পৌঁছেছে। এখানকার ড্রাইভারদের সততার কথা শুনে এলেও ভেতরে ভেতরে ভয়ের বহ্নিশিখা জ্বলে উঠছিল। শিখার সলতে এখনো নিভে যায়নি। প্রশ্ন শোনার পর ছোট বহ্নি আরো ছোট হয়ে মিটমিট করে জিইয়ে রইল, মিলিয়ে গেল না।  

‘আপনার নামটা সুন্দর! নামের মধ্যে মনে হয় রহস্য আছে। নকল নাম নয় তো?’

‘নামটা সুন্দর’ শুনে ভালো লাগলেও, ভালো লাগাটা কর্পূরের মতো মুহূর্তে উড়ে গেল ‘নকল নাম নয় তো’ শুনে। আর তখনই উৎকণ্ঠার সলতেয় যেন ছিটা পড়ল পেট্রোলের। পেট্রোল বোমায় গাড়ি উড়িয়ে মানুষ মেরে হত্যাযজ্ঞ এখন দেশের সাধারণ চালচিত্র হলেও, নিজেও যে পেট্রোল বোমার মতো উড়াল প্রশ্নের শিকার হবে, ভাবতে পারেনি। ‘নকল নাম নয় তো’র বিধ্বংসী শক্তি পেট্রোল বোমার চেয়েও ভয়াবহ নির্মম মনে হলো মনীশের। ধসে যাওয়ার আগে নিজেকে সামলে মনীশ পাল্টা প্রশ্ন করল, ‘আমার নামটা নকল মনে হলো কেন আপনার?’

‘নকল নাম ধারণ করে ওপারের অনেক ক্রিমিনাল এপারে পালিয়ে আসে, আত্মগোপন করে থাকে।’

‘ক্রিমিনাল’ শব্দটাও আরেকবার জলন্ত পেট্রোলের ছাঁচ ছড়িয়ে দিলো দেহে। ভয়ের সলতেয় আবারও দাউদাউ করে উঠল আগুন! কিন্তু ভয় সামাল দিয়ে মনীশ আবার প্রশ্ন করল, ‘আমাকে কি “ক্রিমিনাল ক্রিমিনাল” মনে হয়েছে দেখতে?’

‘না। মনে হয়নি। ভালো মানুষ মনে হয়েছে। তবে ভালো মুখোশের আড়ালে কিন্তু লুকিয়ে থাকে আসল অপরাধীরা, বিষয়টাও মাথায় রাখা ভালো।’

‘জ্বি জ্বি। ঠিক বলেছেন। আমি প্রথম ত্রিশ মিনিট আপনাকে নিয়ে ভীত ছিলাম। রাস্তাঘাট চিনি না, ভয় পাচ্ছিলাম যে অপহরণকারীর ফাঁদে পা বাড়ালাম না তো—এটা ভেবে।’

হো হো  করে হেসে উঠল চালক।

তার হাসির দাপটে চুপসে গেল মনীশ।

আবারও নীরবতা। আবারও ভয়াল আতঙ্কের সলতেয় জ্বলে উঠল আগুন। হঠাৎ আগুন নিভে গেল ট্রাফিক মোড়ের লালবাতি দেখে। সড়কের পাশের সাইনবোর্ডে এবার হিন্দি বর্ণমালায় নিচে শোভা পাচ্ছে ইংরেজি বর্ণমালা। পড়তে পারছে, ম্যাপ অনুযায়ী লোকেশন ধরতে পারছে, ঠিকঠাক এগোচ্ছে, নিশ্চিত হলো সাইনবোর্ড পড়ে—হোসুর রোড, লাক্কাসান্দ্রা, হোমবিগোডা নগর, কর্ণাটক। অর্থাৎ কাছেই এসে গেছে। সবুজবাতি জ্বলে উঠেছে। ট্যাক্সি এগিয়ে যাচ্ছে। কিছু দূর এসে চালক বলল, ‘বাংলাদেশ থেকে এসেছেন, তাই না?’

‘হ্যাঁ। বাংলাদেশ থেকে। কিভাবে বুঝলেন?’

‘লাগেজে আপনার সবই তো লেখা আছে। পড়ে বুঝলাম।’

‘ওঃ!’ এই সহজ বিষয়টা মাথায় এলো না দেখে নিজের কাছে ছোট হয়ে গেল নিজে।

‘বুঝেই তো বাংলায় প্রশ্ন করেছিলাম প্রথমে। আমার মুখে বাংলা শুনে বোঝেননি বিষয়টা?’

‘না। সরি বুঝতে পারিনি।’

ড্রাইভারের বুদ্ধির সামনে নিজেকে তুচ্ছ মনে হতে লাগল।  তবুও বিদেশে বাংলায় কথা বলতে পারছে ভেবে ভালো লাগল। বাংলা বর্ণমালা যেভাবে ভেতরে বাহিরে চেতনার বহ্নুৎসব ঘটায় অন্য ভাষায় কি আর তা ঘটে? ঘটে না। কলকাতায়ও বাংলা বর্ণমালার অনাদর-অবহেলা দেখে মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল, কর্ণাটক রাজ্যে এসে চালকের মুখে বাংলা শুনে মনটা আনন্দে ভরে গেলেও নাম নিয়ে রহস্যমতার উদ্বেগ উড়িয়ে দিতে পারছে না মনীশ। ‘ক্রিমিনাল’ শব্দটির ঝলসানো তাপও এখনো কমেনি। অস্বস্তির পেরেক ঠুকে রইল মস্তিষ্কে।

চালক আবার আচমকা প্রশ্ন করল, ‘মনীশ তো হিন্দু নামের অংশ, “মাহিন” মুসলমান নাম। নাম দিয়ে ধর্মতত্ত্বের পরিচয় মেলে। আপনার নাম দিয়ে চেনা যায় না কোন ধর্মের আপনি।’

ব্রিলিয়ান্ট ব্যাখ্যা শুনে এবারও মুগ্ধ হলো মনীশ মাহিন। নিজের নামের মধ্যে যে হিন্দু-মুসলমান নয়, মানব ধর্মের শিকড় গেড়ে আছে, ভুলেই বসেছিল। এক ঝটকায় মনে পড়ে গেল অতীত থেকে বর্তমানের প্রতিটি মুহূর্ত। ‘মুহূর্তকথা’ সামাল দেওয়ার পর নতুন প্রশ্ন উদিত হলো মাথায়—ড্রাইভার নিশ্চয় শিক্ষিত। শিক্ষিত ছেলেরাও আজকাল ট্যাক্সি চালায় ভারতে। বিশ্বের উন্নত দেশে এটা অমর্যাদাকর পেশা না হলেও, ভারতেও চলছে এ পেশার বিস্তার?

খুব সরল কণ্ঠে চালক জিজ্ঞেস করল, বাংলাদেশের কোন জেলায় আপনার বাড়ি?’

চালকের আবারও প্রশ্নে নড়ে বসল মাহিন। তবুও সময় খরচ না করে ত্বরিৎ জবাব দিলো, ‘কুমিল্লা।’

দুম করে চলন্ত ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে গেল! কিছুটা উড়ে মনীশ ধাক্কা খেল সামনের সিটের সঙ্গে। হাত বাড়িয়ে আগেই ধরে ফেলেছিল, তাই বড় রকমের আঘাত থেকে বেঁচে গেল। প্রথম ভেবেছিল সামনে কোনো পথচারীকে, যেমনটি ভিআইপি সড়কে নেমে আসে বাংলাদেশে, বাঁচাতে কড়া ব্রেক চেপেছিল ড্রাইভার। স্থিত হয়ে বুঝল, না। কোনো বেপোরোয়া পথচারী পথে নামেনি, সামনে কোনো গাড়িও নেই। তবে কেন এভাবে হার্ডব্রেক কষল ড্রাইভার। ভেবে কূল না পেয়ে প্রশ্ন করল, ‘কী হয়েছে ড্রাইভার সাহেব?’

মাথা সামনে রেখে ড্রাইভার অপরাধীর মতো নিচু গলায় জবাব দিলো ‘সরি।’

‘সরি’ শব্দটির বাহিরের প্রকাশ ভঙ্গিটাই বলে দিল, ভেতরের লুকিয়ে আছে পাঁজরভাঙা কাতরধ্বনি, কোনো গভীর দীর্ঘশ্বাসের বীজ কিংবা অব্যাখ্যায়িত কোনো ক্রন্দন।

চুপ হয়ে গেল ড্রাইভার। এখন ম্যাপের রেখাচিহ্ন ধরতে পারছে মনীশ। গন্তব্যে এসে যাচ্ছে ট্যাক্সি। সামনে রয়েছে দীর্ঘ উড়াল সেতু। সেতু পার হলেই লাক্কাসান্দ্রার হোসুররোড পেরিয়ে হাজির হবে ডিমড ইউনিভার্সিটি তথা নিমহ্যান্সে—ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব নিউরোসায়েন্সে হাতে-কলমে শিক্ষার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার শিক্ষা কার্যক্রমের ফেলো হিসেবে যোগ দেবে সে এই বিশ্বখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে।

দূরত্ব কমে আসছে পথের। উড়াল সেতু উড়াল দিয়ে পার হওয়ায় দূরত্ব নেমে এলো শূন্যে। গাড়ি থেকে নামতে গিয়ে অর্ণবের মনে হলো উড়াল সেতু দূরত্ব কমিয়ে দিলেও ড্রাইভারের সঙ্গে এখন থেকে বেড়ে যাবে যোজন যোজন দূরত্ব। ক্ষণিকের সান্নিধ্যের সম্পর্কটা হারিয়ে যাবে জীবনের চোরাপথে।

দুই.

মিটারে ওঠা আশি রুপি নিয়ে একশো রুপির বাকি টাকাটা মনীশের হাতে তুলে দিতে দিতে চালক একটা কার্ডও তুলে দিলো তার হাতে। অবনত মাথায় বলল, ‘প্রয়োজন হলে কল করবেন। কোথাও ঘুরতে চাইলেও জানাবেন। এদেশে কোনো সমস্যায় পড়লেও জানাবেন।’

অচেনা ড্রাইভারের কাছে কী প্রয়োজন থাকতে পারে একজন আরোহীর? কী সমস্যাই বা হতে পারে এ দেশে? ড্রাইভারকে কেন জানাতে হবে সমস্যার কথা? বেড়াতে চাইলে সড়কের পাশে দাঁড়ালে ট্যাক্সির অভাব হবে না, তবু সে আগ্রহ দেখাচ্ছে কেন? অতিভক্তি চোরের লক্ষণ নয় তো? প্রশ্নের ঝড় করোটির ভেতর ঘুরপাক খেতে লাগলেও, নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে, উদিত প্রশ্নের ঝাঁক ঠেলে অবচেতনে ঢুকিয়ে দিয়ে মনীশ জবাব দিলো, ‘আচ্ছা।’

মুখে ‘আচ্ছা’ বললেও, কার্ডে চোখই বোলাল না; চালান করে দিল বুকপকেটে।

ট্যাক্সি স্টার্ট দিয়ে চলে যাচ্ছিল। নিজের জন্য নির্ধারিত হোস্টেলের গেট পেরিয়ে ঢোকার আগে একবার পেছনে ফিরে  তাকাল মনীশ। অজানা এক ইন্দ্রিয়শক্তি ঠেলে বেরিয়ে এসেছে অন্তর্জগৎ থেকে। বিস্ময় নিয়ে মনীশ দেখল থেমে আছে ট্যাক্সিটি। আর চালক অন্যরকম ব্যাকুল চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে।

প্রথমে ভয় পেলেও মাইক্রো সেকেন্ডের ব্যবধানে ভয়শূন্য নতুন বোধের আঁচড় খেল মাহিন। ভেতরের বোধ জানান দিলো ভয় পাওয়ার কিছু নেই।

কেন ভয় মোচড় দিয়ে উঠেছিল? কেন তা মুহূর্তে উড়াল দিলো? বিশ্লেষণ করার সুযোগও পেল না মনীশ। কাঁধের ব্যাগটা বাঁ হাত ধরে চাকা সাঁটানো বড় লাগেজের হাতল টেনে এগোতে লাগল সে অভ্যর্থনাকক্ষের দিকে। নিজের পরিচয়পত্র বের করতে গিয়ে চালকের দেওয়া ভিজিটিং কার্ডটি পড়ে গেল ফ্লোরে। অভ্যর্থনাকক্ষের ম্যানেজার বলল, ‘কী যেন পড়ে গেছে নিচে। দেখুন।’

থ্যাংক ইউ। বলেই বসে কার্ডটা তুলতে গিয়ে, দেখার মতো দেখা যাকে বলে, সেভাবে একবার পড়ে নিল কার্ডটা। প্রথমেই চমকে উঠল নাম দেখে—মনীশ মালহোত্রা। চালকের ঠিকানা আর সেলনম্বর ছাপা আছে কার্ডটিতে। একই নামের কাউকে দেশের ভাষায় ‘মিতা’ বলে সম্বোধন করে, চালককে কেবল মিতাই মনে হলো না এই মুহূর্তে, চলার পথে যে সর্বগ্রাসী ভয় মাঝে মাঝে অমূলকভাবে চাপে ফেলছিল, চাপমুক্তির আনন্দরসে ভরে গেল দেহ-মন। এই আনন্দে কোনো দূষণ নেই, ফরমালিনের গোপন আক্রমণ নেই, এই আনন্দ বিদেশের মাটিতে সাহস জোগাল, ক্ষণকালের জন্য হলেও এদেশে লম্বা সময়ের নিরাপত্তার অশ্রয় পেয়ে গেল মাহিন।

তিন.

ডাইনিং হলে খেতে এসে নতুন চমক খেল মনীশ। ভেবেছিল ‘ভেজে’র দেশে এসে শাক-সবজি ছাড়া কিছুই খেতে পারবে না। ‘ভেজ’ কাকে বলে টের পেল টেবিলে সাজানো ডিশ দেখে। প্রিয় ঢেঁড়সভাজি, চাপাতি এবং ডাল সাজানো দেখে জিবে পানি চলে এলো। দেশে এটাই ছিল তার প্রিয় আইটেম, বেঙ্গালুরুতে এই ডিশের প্রথম উপহার উপভোগ করে খেল সে। তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে টেবিল থেকে ওঠার সময় দেখল একের পর এক ডিশ আসছে—ভাতের গামলা, আলু-চিকেন মশলা রান্নার ডিশ থেকে ধোঁয়া উড়ছে, অন্য রকম পাগল করা সুঘ্রাণ ছড়িয়ে যাচ্ছে চারপাশে, ভরা পেটেও জাগিয়ে তুলল দানব ক্ষুধা।

বিস্ময় নিয়ে দেখল চাপাতি খাওয়ার পর অন্যরা প্লেট ভর্তি করে ভাত নিচ্ছে আর নিচ্ছে চিকেন-ঝোল! তাহলে কি এতক্ষণ যা খেল তা আপিটাইজার হিসেবে খাওয়া হয় এখানে?

নতুন শিক্ষণ কাজে লাগাতে আবার বসল টেবিলে... আবার ও নতুন উদ্যমে খেয়ে ফিরে এলো রুমে।

ভিআইপি রুমে একা বরাদ্দ পেয়েছে মনীশ। অন্যকোনো রুমমেট নেই। তবে পাশের রুমে অজয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। বাংলাদেশের ইংরেজি মিডিয়ামে পড়ুয়াদের মতো অজয় অনর্গল সুন্দর কথা বলে ইংরেজিতেই। নতুন শিক্ষার্থীকে আন্তরিকভাবে বরণ করে নিয়েছে সে। একই সাবজেক্টের সেও শিক্ষার্থী। এ মুহূর্তে রুমে ঢুকে বলল, ‘বাহ! তুমি তো ভালোই গুছিয়ে নিয়েছো রুম।’

রুমটা গোছানোই ছিল। প্রয়োজনীয় বইয়ের পাশাপাশি টেবিলে মাক্সিম গোর্কির গল্পসমগ্র, প্রতিভা বসুর গল্পসমগ্র, শাহীন আখতারের ময়ূর সিংহাসন, নরেন্দনাথ মিত্রের শ্রেষ্ঠ গল্প আর বাংলা একাডেমির মাসিক পত্রিকা উত্তরাধিকার-এর কয়েকটি সংখ্যাও সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে মনীশ।

বিস্ময় নিয়ে অজয় বলল, ‘নরেন্দ্র মিত্র আর প্রতিভা বসুরও বই পড়ো!’

‘হ্যাঁ। পড়ি। বাংলা ভাষার সব বিখ্যাত লেককদের বই পড়া হয়ে গেছে। সবার সব বই না পড়তে পারলেও বিখ্যাত সব বই পড়ে ফেলেছি।’

‘বাহ! ইউ আর দি গ্রেট?’

‘এখানে গ্রেটনেসের কী দেখলে। যান্ত্রিক পড়ার পাশাপাশি সাহিত্য পড়া উচিত নয়?’

‘উচিত। অবশ্যই উচিত। তবে কোর্স পুরোদমে শুরু হয়ে গেলে অনুচিতের তলে চাপা পড়ে যাবে তোমার ঔচিত্য।’

‘না। ঠিক নয় কথাটা। মানলাম না তোমার কথা। যতই চাপে থাকি না কেন, রিলাক্স থাকার চেষ্টা করি আমি। সাহিত্য পড়ে নিজেকে রিলাক্স করে নিই। চাপের সর্বগ্রাসী পরিণতি এভাবে জয়ও করা যায়। তুমি সাহিত্য পড়ো না?’

প্রশ্ন শুনে থমকে গেল অজয়। জবাব এড়িয়ে বলল, ‘আমাদের দেশে তো বহু ভাষা।’

‘বহু ভাষার ওপর তো হিন্দি ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার কথা ঘোষণা করেছেন নির্বাচিত বর্তমান সরকার, হিন্দি ভাষার আধিপত্য কি অন্য ভাষাকে দমিয়ে দেবে না?’

‘দমিয়ে রাখা যায় না কোনো ভাষা, এতটুকু জানি।’ বলতে বলতে ময়ূর সিংহাসন উপন্যাসটি হাতে নিয়ে পাতা উল্টিয়ে দেখতে লাগল অজয়।

খুশি হয়ে মনীশ প্রশ্ন করল, ‘তুমি কি বাংলা পড়তে পারো?’

হাসল অজয়। এ প্রশ্নের জবাবও সরাসরি না দিয়ে উত্তর দিলো, বইগুলোর শিরোনাম না পড়ে কি ‘নাম’ উল্লেখ করতে পেরেছি?’

‘ওঃ! তাই তো!’ উল্লাসে ফেটে পড়ল। ইংরেজিতে কথা বললেও, বাংলা বলতে না পারলেও পাশের রুমের একজন বাংলা পড়তে পারে জেনে আনন্দে ঝাপিয়ে ধরল অজয়কে।’

মনীশের আচমকা আক্রমণে বিরক্ত নয়, মুগ্ধ হয়ে গেল অজয়। ইন্ডিয়ান শীক্ষার্থীদের অসংখ্য ভাষাভাষির মধ্যে প্রতিযোগিতা করতে হয়, তাই কেবল মায়ের ভাষায় আঁকড়ে থাকলেই চলে না। ইংরেজি চর্চায় দক্ষ না হলে প্রতিযোগিতায় এদেশে উপরে ওঠা যায় না। এই ভয়াবহ বাস্তবতা ভালোই বুঝতে পারে অজয়। নিজের বর্ণমালার জন্য মনীশের বেপোরোয়া টান দেখে ভেতর থেকে হাহাকার বেরিয়ে এলেও নিজের মাতৃভাষার কথা প্রকাশ করতে পারল না সে।

‘তুমি বাংলা পড়তে পারো, অথচ বলতে পারো না, এ কেমন ছেলে তুমি?’ প্রশ্ন করল মনীশ।

হাসল অজয়। পুরোপুরি জবাব দিল না এবারও। রহস্যের একটা ছাঁচ লেগে রইল তার মুখে । ভাষার জন্য বাংলাদেশের বেপোরোয় তরুণটির প্রতি শ্রদ্ধা বেড়েছে, সঠিক উত্তর দিলে সে হয়তো কষ্ট পাবে, তাই ঘুরিয়ে বলল, ‘যে ভাঙা ভাঙা পড়তে পারে, সে বলতে পারে না, কথাটা ঠিক নয়।’

‘তাতেই খুশি আমি । ভারতে বাংলার অনাদর দেখে বুক ভেঙে যায় আমার। এমনকি কলকাতাতেও বাংলার আধিপত্য তো নেই-ই, বাংলা মিডিয়ামে পড়ার হারও দিনে দিনে কমে আসছে। ঢাকার বনেদি পাড়া তো বটেই, জেলাশহরেও ইংরেজি মিডিয়ামের স্কুলে গজিয়ে উঠছে ব্যাঙের ছাতার মতো।

অজয়ের বুকের পাটতন ভেঙে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরোল। দীর্ঘশ্বাসের আড়ালের হতাশা এ মুহূর্তে জানা হলো না মনীশের।

বিভিন্ন ভাষার দাপটে বাংলা ম্লান হওয়ার বিষয়টা অজয় পুরোপুরি বিশ্বাস না করলেও গোপন দুঃখস্রোত মুখে ছড়িয়ে দিলো প্রকাশিত বিষাদের ছায়া। টানাপোড়েনের মধ্যে থেকেও ভাষাকে লালন করার প্রকাশ্য আলো মনীশের মধ্যে দেখে, নাড়া খেল আপন সত্তা। আর সেখানেই অজয় অন্য রকম টান বোধ করল। সেভেন স্টার এক হোটেলে রাতে যে পার্টির আয়োজন করেছে একটা কোম্পানি, সেখানে যাওয়ার জন্য অজয় নিমন্ত্রণ করল মনীশকে।

হোস্টেল ক্যাম্পাসে বিশাল এক বাস এসে দাঁড়িয়েছে। এক বিখ্যাত ওষুধ কোম্পানির নতুন একটা প্রডাক্ট লঞ্জ হবে। সবাই দলবেঁধে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে বেরিয়ে গেছে। বাসে উঠে বসেছে। মনীশকে না দেখে অজয় কল করল ওর সেল নম্বরে।

কল পেয়ে মনীশ জবাব দিল, ‘ওঃ! আসছি দোস্ত!’

বাংলায় কথাটা বলে ফেলেছে মনীশ। ভেতরের শুদ্ধতর জোয়ারের মধ্যে থেকে মাতৃভাষায় উৎসারিত শব্দটা ফেনিল উচ্ছ্বাসের শুভ্রতা ছড়িয়ে ঘোষণা দিয়েছে আত্মপরিচয়। শিকড়ের বিপুল আলোর উদ্গীরণ ঘটে গেছে তাড়াহুড়ো করে বেরোনোর জন্য তৈরি হতে গিয়ে। সেই উচ্ছ্বাসের শুভ্রতা ছুঁয়ে গেল অজয়ের প্রাণ। টের পেল না মনীশ। তবে টের পেল হঠাৎ নিজের বাংলা বলা কথার ঢঙটি। বুঝে বাংলা বলার ঢঙটা শুদ্ধ করার জন্য তড়িঘড়ি করে ইংরেজিতে মনীশ আবার বলল, ‘সরি। ইউ কান্ট আন্ডারস্ট্যান্ড মাই স্পনটেনিয়ান্স অ্যাপ্রোচ, ইনার ওয়ার্ডস কামিং ফ্রম ডেফথ অব মাই মাইন্ড।’

অজয় চুপ হয়ে গেল। লাইন না কেটে সেলফোনটা কানে ধরে রইল। মনীশের শুদ্ধতম উচ্চারণের প্রভাবে ভেতরের অবশ করা ভালো লাগাটা উপভোগ করল। উত্তর দিতে পারল না।

বাস ছেড়ে যাবে—এমন সময় মনীশ মাহিন অনেকটা দৌড়ে উঠল বাসে। তাকে দেখে বাসে বসা অনেকেই চট করে দাঁড়িয়ে গেছে।

অজয়ও প্রথমে চিনতে ভুল করল মনীশকে। সবার সঙ্গে সেও দাঁড়িয়ে গেল। মুহূর্তেই নিজের ভুল বুঝল স্যুটেড-বুটেড হয়ে বাসে ওঠা মনীশকে চিনতে পেরে। দেখে মনে হচ্ছে নতুন কোনো প্রফেসর ছাত্রদের সঙ্গে যাওয়ার জন্য বাসে উঠেছে।

সবার দাঁড়িয়ে যাওয়া দেখে হতভম্ব মনীশ মুহূর্তে নেমে এলো বাস থেকে। এক ঝলক যাত্রীদের দেখে ভাবল, ভুল বাসে উঠেছে সে। সেভেন স্টার হোটেলে যারা পার্টিতে যাবে তাদের পরনের ড্রেস সাদাসিধা, একদম সিম্পল! একি করে হয়!

বাস থেকে মনীশকে নেমে যেতে দেখে অজয়ও নেমে এলো।

ফিসফিস করে ইংরেজিতে বলল, ‘স্যুট খুলে আসো। টাইটাও খুলে আসো। এই রকম গর্জাস ড্রেসে কেউ এখানে এভাবে পার্টিতে যায় না।’

‘বলো কী!’ তবে যে হিন্দি সিনেমার দৌরাত্ম্যে আমরা দেখি প্রতিনিয়ত জৌলুশ আর আভিজাত্যের ভয়াবহ বিস্ফোরণ, সেটা কী?’

‘সেটা ভুয়া এই অঞ্চলে। এখানে সবাই সাদাসিধা পোশাকে চলাফেরা করে। যাও ড্রেস বদলে আসো।’

হঠাৎ নিজেকে মনে হলো জলের মাছ ডাঙ্গায় উঠে এসেছে। সংকোচ আর জড়তার শেকলে আটকে গেল পা। বাসের সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে, ডাঙ্গার জ্যান্ত মাছের মতো ছটফট করছে সে। একবার মনে হলো এই মুহূর্তে চিড়িয়াখানার আজব এক প্রাণীকে দেখছে সবাই। মজা পাচ্ছে। ত্বরিৎ সিদ্ধান্ত নিল, ‘তোমরা যাও। আমার যেতে ইচ্ছা করছে না। রুমে ফিরে যাই।’

বাস স্টার্ট নিচ্ছে। এগোতে শুরু করেছে। অজয় একছুটে উঠে বসেছে বাসে। রুমের দিকে ফিরে যাচ্ছিল মনীশ। একসময় গার্ড এসে বলল, ‘আপনার দুজন মেহমান এসেছেন। ওয়েটিং রুমে বসিয়েছি।’

‘আমার মেহমান?’

‘হ্যাঁ। আপনার।’

‘এদেশে তো আমার পরিচিত কেউ নেই।’

‘নেই বলছেন কেন? অবশ্যই আছে। নইলে কোত্থেকে এলেন তারা?’

সন্ধ্যে সাতটা। আঁধার বোঝা যায় না। চারপাশের ঝলমলো আলো আর আলো। বৈদ্যুতিক আলোর উদ্ভাসের সঙ্গে মিশে গেল নিজের চোখের আলো। ওয়েটিং রুমে বসে আছে এক তরুণী আর তার সঙ্গে সাত/আট বছরের এক ছেলে শিশু। কোত্থেকে এলো তারা? আলাদ্দিনের আশ্চর্য প্রদীপের দৈত্য কি তবে এদেশেও উপহার হিসেবে পাঠিয়ে দিয়েছে ওদের?

বিস্ময় আর প্রশ্নভরা চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে রইল মনীশ। তরুণীটির চোখ ঝলমল করে উঠল। মুখে খেলে গেল আশ্চর্য এক আলোর নাচন। আলোর বিভাব থেকে হিন্দি ভাষায় প্রশ্ন ছুটে এলো, ‘আপনিই মনীশ মাহিন?’

‘হ্যাঁ। আমিই...’

‘আমি’ ... বলেই থেমে গেল মেয়েটি। হাতে ধরা ভিজিটিং কার্ডটি বের করে দিল মনীশের উদ্দেশে।

সেই কার্ড... টেক্সি চালক মনীশ মালহোত্রার কার্ড। কার্ডটি হাতে নিয়ে বোকার মতো সে তাকিয়ে রইল মেয়েটির দিকে।

‘জ্বি। আমি ওনার মেয়ে মাহিন মালহোত্রা। আর ও আমার ছোট ভাই আশিষ মালহোত্রা।’

পরিচয় পেয়ে আবারও চমকে ওঠল মনীশ। টেক্সি চালক নিজের তরুণী মেয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে হোস্টেলে? কোনো ফাঁদ নয় তো?

আচমকা প্রশ্নটি মস্তিষ্কে ঘূর্ণি তুললেও মুহূর্তেই ঘূর্ণিটি থেমে গেল যখন দেখল আশিষ মালহোত্রা তার হাত ধরল সহজ-সুলভ শিশুতোষ ভঙ্গিতে। বুঝিয়ে দিতে চাইল তারা দীর্ঘদিনের পরিচিত, অতি আপন কেউ।

মাহিন মালহোত্রা মানে তরুণীটি বলল, ‘বাবা বসে আছেন বাইরে টেক্সিতে। আমরা আপনাকে নিতে এসেছি আমাদের বাসায়। ওই যে, দেয়ালের ওপাশে বাসা—ক্যাম্পাসের দেয়ালের পাশ দিয়ে ঘুরে যেতে হবে আমাদের বাসায়। সময় লাগবে মাত্র এক মিনিট, চলুন।’

বুকের ভেতর নড়ে ওঠা ভয়ের পাখিটা পাখা ঝাপটাল আবার। মায়ার রশ্মিতে ভরা বুকআকাশে নীল মেঘের ঘূর্ণি উঠল। আকাশ ফুঁড়ে হঠাৎ ডানা মেলে উড়ে গেল ভয়। বুকের খাঁচায় বন্দি আবেগের ঘরে আছড়ে পড়ল অচিন দেশ থেকে ছুটে আসা আলোর উল্কাপতন। পূর্বপুরুষদের আকাঙ্ক্ষা নেভানো প্রদীপের শিখায় আকস্মিক জ্বলে উঠল আগুন। মেয়েটি বলল, ‘আমার বাবার দাদার বাড়ি বাংলাদেশে, কুমিল্লায়। আপনি কুমিল্লা থেকে এসেছেন শুনে ঠামা (ঠাকুর মা) আর আমার মা আপনাকে দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে গেছেন। আপনাকে দেখতে চেয়েছেন। যাবেন আমাদের বাসায়?’

মনীশ মাহিনের রক্তে ছুটতে লাগল অস্বাভাবিক দ্রুতগতি সম্পন্ন রেসের ঘোড়া। ঘোড়াদৌড় সামাল দিতে পারল না সে। বসে পড়ল চেয়ারে। বসলেও চেতনার নীরব সত্তায় ঝাঁকি খেয়েছে, জেগে উঠেছে গহীন শিকড়ের তলে জমানো নিথর আর কোমল জলের কম্পমান ঢেউয়ের স্পর্শ পেয়ে। ‘মাহিন মালহোত্রা’ ‘মনীশ মালহোত্রা’ বাবা-মেয়ের নামের সঙ্গে নিজের নাম ‘মনীশ মাহিন’ জুড়ে থাকার আলৌকিক সম্পর্কটার কারণে জেনেটিক কোড দ্বারা সংরক্ষিত অচেনা-অজানা সাম্রাজের গোপন কপাট দুম করে খুলে গেল চোখের সামনে।

মনীশের দাদীমা ছিলেন হিন্দু। কুমিল্লার স্কুলে পড়ার সময়, নবম শ্রেণীতেই মুসলমান এক ছেলের সঙ্গে প্রেম করে ভেগে যান। মুসলমান হয়ে বিয়ে করেন ছেলেটাকে। সেই ছেলেই ছিলেন মনীশ মাহিনের দাদা। রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে টিকতে পারেননি তিনি। ঘর ছাড়তে বাধ্য হন। নিজের বাড়িতেও ঠাঁই হয়নি তার। তারপর কোনো হদিস পাওয়া যায়নি দাদীর। দাদীর পরিবার শোকে কাতর হয়ে পাড়ি দিয়েছিলেন ভারতে। ভারতে ছিল তাদের অনেক স্বজন। তারপর আর কোনো হদিস মেলেনি কারো। নামে নামে মিল এবং বংশধরদের আবাস ভূমির অদ্ভুত মিল চোখ খুলে দিলো মনীশ মাহিনের। ভয়ের পাখিটি উড়াল দিয়ে পালিয়ে গেল। শিকড়ে ডোবানো অতীতের গোপন কুঠুরি থেকে জেগে উঠল আনন্দের পাখি। পৃথিবীর শুদ্ধতম অনুভূতি ধারণ করে মনীশ মাহিন জবাব দিলো ‘যাব। তোমাদের বাসায় যাব। তোমার মা আর বাবার সঙ্গে দেখা করব।’

চার.

যাব বললেও যাওয়া হয়নি। পড়াশোনার চাপে চাপা পড়ে গিয়েছিল আবেগ। মাস খানেক কেটে গেছে। রমজান শুরু হয়েছে। মনীশ মাহিন মুসলমান ধর্মের সব রীতিনীতি পালন করে, তেমন নয়। রোজা রাখত দেশে। এখানে সেহেরি খাবারের ব্যবস্থা নেই বলা যাবে না, অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়। তাই রোজা রাখা হয়নি। তবে জুম্মার নামাজ পড়ে সে। হোস্টেল থেকে মসজিদ অনেক দূরে। যেতে হয় আটোতে। জুম্মা শেষে মসজিদ থেকে বেরিয়ে অটো খুঁজতে যাবে, এমন সময় সেখানে দেখল সেই টেক্সিক্যাব। মাহিনকে দেখে মনীশ মালহোত্রা এগিয়ে এসে বলল, ‘আমার টেক্সিতে উঠুন। পৌঁছে দিয়ে আসি আপনাকে।’ সে যে তাদের বাড়িতে যায়নি, সে ব্যাপারে কোনো অনুযোগ করল না।

আবদার উপেক্ষা করতে পারল না মাহিন। চলন্ত গাড়িতে মালহোত্রা প্রশ্ন করল, ‘দুদিন পরই তো ঈদ, ঈদে কি দেশে যাবেন?’

‘না। দেশে যাওয়া হবে না। সামনে পরীক্ষা। এখানেই ঈদ কাটাতে হবে।’

‘ওঃ!’

‘ঈদের নামাজ কোথায় পড়বেন? সকালে কোথায় খাবেন?’

‘এ মসজিদের ঈদগাহতেই পড়ব আশা করছি।’

‘ঈদগাহতে যাওয়ার আগে মিষ্টি মুখ করে যেতে হয় না?’

‘হ্যাঁ। সেটা রেওযাজ। সব রেওয়াজ তো সব সময় পালন করা যায় না।’

‘ওঃ!’

‘মাহিন মালহোত্রা কেমন আছে?’ প্রশ্ন করল মনীশ মাহিন।

‘ভালো। ওদের সবার ইচ্ছা, আমারও, একবার যদি দয়া করে আমাদের বাড়িতে...?’

কথা শেষ করতে পারল না মালহোত্রা। মাঝ পথে আটকে দিয়ে মাহিন বলল, ‘একদিন যাব। অবশ্যই। পরীক্ষাটা শেষ হোক। দেশে ফেরার আগে দেখা করে যাব সবার সঙ্গে।’

ট্যাক্সি থেকে নামার পর কিছুটা এগিয়ে গিয়ে আবার ফিরে তাকাল মাহিন।

অবাক হয়ে দেখল সেই চোখ। মণি থেকে বিপুল আলোর বিকিরণ ঘটছে। ছুঁয়ে যাচ্ছে মাহিনের চোখও। মমতার কোমল নদীতে ঢেউ জাগল। কেন জাগল জানে না সে।

পাঁচ.

ঈদের দিন ভোরেই ঘুম থেকে উঠেছে মনীশ মাহিন। দেশের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলার জন্য মোবাইলফোন অন করে দেখে চার্জ নেই সেটে। মনটা চট করে খারাপ হয়ে গেল। বিষণ্ণ মনের মধ্যে আচমকা ঘটল উল্লাসের বিস্ফোরণ। পড়ার টেবিলের দিকে তাকিয়ে দেখল তিনটি বই সাজানো রয়েছে টেবিলে! সঙ্গে একটা হলুদ গোলাপ। কাগজে ছোট্ট করে লেখা, ‘ঈদউপহার তোমার জন্য।’ অজয়

ভাঙা ভাঙা বাংলা লেখার মধ্যে মমতার যে মর্মস্পর্শী ছোঁয়া রয়েছে, শব্দগুচ্ছের মধ্যে চাঁদ আর সূর্যের সম্পর্কের মতো যে সুশৃঙ্খল কর্মযজ্ঞ রযেছে তেমনি প্রেরণাময় আলো ছড়িয়ে গেল অন্তরজুড়ে। বই তিনটি উল্টেপাল্টে দেখতে লাগল মাহিন—প্রথমেই রযেছে বাংলা অনূদিত দে’জ পাবলিশিং-এর গাবরিয়েল গার্সিয়া মাকেসের গল্পসমগ্র, ভাষান্তর অমিতাভ রায়। পরের বইটা সুনীল গঙ্গোঁপাধ্যায়ের পাঁচটি প্রেমের কাহিনী। এই গ্রন্থটিও অন্তর জুড়ে ছড়িয়ে দিলো ঈদের খুশি। তার পরেরটা শ্রী পান্থের ক্রীতদাস। আলো ছড়াতে লাগল চারপাশে, অন্তরে বাহিরে।

বই তিনটি ওল্টাতে গিয়ে বেরিয়ে এলো ছোট্ট একটা চিরকুট। তাতে লেখা, ‘আমি কলকাতার ছেলে। সেই পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করেছি। বাঙলা ভালো বলতে পারি না, পড়তেও তেমন পারি না। বাংলায় লেখাটাও আমার কাছে কঠিন। ছোটবেলা থেকে ইংরেজি মাধ্যমে পড়ার জন্য আমার এ দশা। আর তোমার মধ্যে দেখেছি প্রিয় বর্ণমালাকে ধারণ করার তীব্র আবেগ। তোমার সে আবেগকে শ্রদ্ধা জানাই ঈদের দিনে।’ অজয়

বুকের খাঁচায় অবরুদ্ধ বর্ণমালার পাখিগুলো আবার পাখা ঝাপটাল। বুকের খাঁচা খুলে দিতে ইচ্ছা করল, মুক্ত পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিতে ইচ্ছা করল আপন বর্ণমালার বর্ণিল আলো। এই অপূর্ণ ইচ্ছা ইতোপূর্বে পূর্ণ করে রেখেছেন বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর কারণে বাংলাভাষা স্থান পেয়েছে বিশ্বদরবারে। প্রিয় কবিকে একবার গভীর করে শ্রদ্ধা জানাল মাহিন।

ছয়.

ঈদগাহ  যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে রুম থেকে বেরোতে যাবে, এমন সময় ‘হোস্টেল বয়’ এসে বলল, ‘আপনার কয়েকজন মেহমান এসেছেন। তাদের বসিয়েছি ওয়েটিং রুমে।’

নিশ্চয় মাহিন মালহোত্রা! প্রথম ইম্পালস্-এ ভেতরের অনুভবে নাড়া খাওয়ার পর দরজা বন্ধ করে মেহমানদের বসার রুমে ঢুকে বুক কেঁপে উঠল মনীশ মাহিনের। পাঁচ জনের একদল এসেছে। মনীশ মালহোত্রার হাতে  ঢাউস সাইজের দুই টিফিন ক্যারিয়ার—সঙ্গে মাহিন মালহোত্রা তো আছেই। সে-ই পরিচয় করিয়ে দিলো, ‘উনি আমার ঠামা, আর ইনি আমার মা।’

ছোট্ট শিশু আশিষ মালহোত্রা বলল, ‘আমাদের বাসায় তো তুমি গেলে না। তাই ঈদের দিনে আমরাই চলে এলাম তোমার কাছে।’

নিজেকে অপরাধী মনে হতে লাগল মনীশ মাহিনের। বিদেশে এমন মমতার ছোঁয়া পেয়ে উদ্বেলিত আবেগের প্লাবনে চোখে পানি চলে এলো।

ঠামা বললেন, ‘নাও। মিষ্টিমুখ করো। তারপর যেও ঈদগাহে। বাংলাদেশের কুমিল্লার ছেলে তুমি। কে জানে আমাদেরই ছেলে কিনা, আমাদেরই রক্ত তোমার দেহে বহমান কিনা! খুড়ে দেখতে চাই না সেই সত্য-মিথ্যা। কেবল ঈদের দিনে আনন্দের সঙ্গে অনুভব করতে চাই, আমাদের আদি মৃত্তিকারই সন্তান তুমি।’

অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

এ সম্পর্কিত আরও খবর