অতনু সিংহের একগুচ্ছ কবিতা

, শিল্প-সাহিত্য

অতনু সিংহ | 2023-08-25 20:08:14

সেদিনের সোনাঝরা সন্ধ্যায়

ওই ঘনায়মান আঁখি, ওই বরষা আসবে ব’লে হাওয়া, ওই নদী দিয়ে ঘেরা শহরের নিঝুম মিনার, ওই সিএনজি থেকে নেমে একছুটে সড়কের ওই পার, ওই রিক্সার ভিতরে আর্দ্রতা এসে গেলে ওই ঘাড় কাত ক’রে হামদর্দের ফুটপাত—ওই রোদ চশমা ছাড়ায়ে উঁকি দ্যায় কে! ওই তো ব্যালকনিতে হেলানো চেয়ার, পাশ থেকে ভেসে আসে ফোনকল, ওই তো তোমার ডাক...ডাকযোগে আলো নিভে এলে পল্টন পার ক’রে ছুটে যায় ফিটন গাড়িটি বেশ... তোমার চোখ টমমল!
আজ বৃষ্টি আসবে ব’লে চিলেকোঠায় বিড়ালের আনাগোনা বেড়ে যায়! কলোনির মরা চিমনির চাঁদে বিজাতীয় তাসা বেজে ওঠে! ছোটবেলা, টায়ফয়েড মনে প’ড়ে। হাতির ঝিলের থেকে অনেক দূরে দিনলিপি কাটাকুটি লেখা হয়, এই শালিখা নগরের ট্রাঞ্জিস্টার থেকে শ্যামল মিত্র সারারাত রেকর্ডিং গেয়ে যান, আকাশবার্তার কথা মনে হয়
চামড়ায়, বেদনার প্রেক্ষিতে চোখ তুলে তোমার গলুইয়ের রীতি মনে পড়ে! সহজাত ঢেউয়ের সহজযাপন, জলের রহস্য, চলাচল সহজ...
এইখানে পানি বাঁধা পড়ে থাকে, পাক খায়। তোমাদের পানির মুখরা আমাদের অন্তরে তোমার বাগগরিমা, নদীর কণ্ঠধারা এই রুখাসুখা দ্বীপে বহমান কবে? কবে বলো ধারাপাত ঝরঝর একসাথে সারারাত, কবে ফের? কবে ধারা নতুনপুরের মুখ আমাদের সড়কযোজনায়?

মেহেদি হাসান যেটুকু চেয়েছেন

শেষবার জানলা খুলে এসো, আর
দরজা ভিজিয়ে বেসিনের কল বন্ধ করে
শেষবার চলে যাও, রেডিও-যুগের মতো
খুব মৃদু-স্বরে অথবা পর্দা উড়িয়ে
শান্ত মোজার পাশ দিয়ে এসো..
দু’মিনিট বসো, অতর্কিত
চলে যাও দমকা হাওয়ার ঘোরে,
যেভাবে থেমে যায় গান
চলে যাও, তারপর মানুষেরা ছাদে যাবে,
স্নানের গন্ধ হবে আমাদের ঘরে,
আমাদের সাবানস্বপ্নে...
শেষবার আলোছায়া, একটুকু
ঘুমের আড়াল দিয়ে হলুদ নাইটি পরা কবেকার
স্বাগত-আকাশ, দেখে যেতে পারো
ভুলের মাশুল কত বড়.. বড়-বড় গাছ হয়,
বেদনার অর্কিড কেমন
কাঁটা দিয়ে তুলে নেয় কাঁটা, ফুরোয় শরীর
বিছানায়, বমিতে, রক্তের চাপ-চাপ সুরে

কবিতা

কবিতা থেকে একটু পৃথকে, এবার তোমাকে চাই—চৈত্রের ঘ্রাণ পেরিয়ে পেরিয়ে আসন্ন আম্রপল্লব মায়া ঢেলে দিলে, একান্ত দাওয়ায় চাই তোমার দাওয়াত... ক্ষুধার অন্নজল শেষে তোমার সকল আলাপ য্যানো ছায়াবাজী—মাদুরে, যৌনভিক্ষায়... কবিতায় কী বা আসে যায়, সীমানা-পরিখা সকলই যে যার মতো জেগে থাকে! কবিতা ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে এইবার ধরো পশ্চিম থেকে ওই পূবের ধারায়, যেভাবে সকল মানুষ ফেরে একান্ত জানালায়! কালবোশেখের হাওয়ায় সুগন্ধী ইশারা কার দুলে ওঠে, সন্ধ্যার মুখে আজও বর্ণমালার জাদু খুঁজে পায় সুরায়া বালিকা, দ্যাখো তার আয়নায় জমে ওঠে রূপপুর, আলোবাজী, সকল গল্পগাছা, চন্দ্রাহত প্রেমিকের ঝিমভরা গান!

তোমাকে লেখা এই মুখরতা এই নীরবতা আমার

আধখানা উঠোন পেরিয়ে
আমি এসেছি ভাঙা তবু ডাঙা ভ’রে ওঠা
আমার আরেক উঠোনে,
আর দেখি এই চরাচরে আমিই তো জেগে আছি
কেননা ভাষার ভিতরে সকল হুররায় এবং নীরবে
যে নদীজল আগায়ে গিয়েছে
উৎস থেকে অথৈপাথারে
সেই আকুলিবিকুলি জলেও
দ্যাখো উঠোনের কণামাটি ধুয়ে ধুয়ে
অকূলপ্রবাহে মিশে আছে, মিলেমিশে

আমি টানি হাল, বৈঠার জাদুকাঠ
মাছ ধরি, বুনি চাঁদ, খোয়াব সাকার করা
নেশাধরা পূর্ণিমা, হুহুপনা, আহা রাত,
মাঠেঘাটে, খাতার আখরে
আমি বীজের গল্পবুনি
আর চরাচরে দেখি তুমি শাপলা-রঙের ভিতর
দেখি তুমি বহমান, বয়ে যায় আধোকথা,
লতালতা কাজল কাজল
আর শালু লাল, আর মেঘ এবার সিঁদুর

তোমার স্রোতের কাছে

এসেছি ভাসাতে আমায়, ভাসাতে আমারে,
এসো স্মৃতি ধারণ করি বুলেটবিদ্ধ আমাদের
পাঁজরের মাঝখানে যে অন্ধকার,
যেইখানে রক্তের ভিতরে বেজে চলে
হাওয়ামহলের দিকে ভেসে আসা
হাওর-মাঝিদের সমবেত গান...
আমি স্মৃতির পহেলা আয়াতে
জাগাই রাধানগরের গাছগাছালিকে
বুড়িগঙ্গা দিয়ে সরস্বতী জলরেখা পানে দ্যাখো
চাঁদফকির ভেসে যায়
উঠোনে জেগে ওঠে বর্ষাকালীন গৌরীসঙ্গীত

মৈথুনে, ঘামে, কান্নায়, ক্রোধে, এবাদতে,
আমি, আমিই তো, জ্বি আমি
উঠোনের মাঝখানে স্মৃতিঘেরা সত্তার
প্রবল কসমে হ্যাঁ আমি দাঁড়িয়ে রয়েছি
প্রমিতের তলাতল বানোয়াট ভেঙে দিতে
উঠোনে উঠোনে খোল-করতালে
ফের নাচ, নৃত্যের দ্রোহপ্রেম বুঝে নিতে
আহা তন্ত্রমন্ত্র আহা মন্ত্রহীন চিতার চণ্ডাল
আহা সুফিয়ানা, আহা নটরাজ
বাক্যের শুরুতে ছিলাম আমি, আছি
শেষেও তো আমি, আজ্ঞে,
আমি মানে বাক্য, যতি ও স্পেস,
স্পেস স্পেস নীরবতা
ইতিহাসের আগেও যে ইতিহাস
মিথের পূর্ব থেকে যে ইহাকাল আহা ইহাকালে
আমাদের জাগতিক স্বপ্নের যে অধিকার
রক্তে ও আয়নায় তাহার সাকারে,
তোমা হতে তোমাতেই ওগো
কাদামাটি মেখে খাড়ায়ে রইছি
আমাদের চরাচর উঠোনে,
আর তোমার-আমার ভিতর...
ধরো, ঘুম থেকে ভোরবেলা উঠে
আবার সে হারমোনিয়াম, চিঠি লেখা,
মৃদুগান, জলসেচ, সাইকেল
বিনিময়, কেনাবেচা, হাসিফুল, স্বাভাবিক কান্নার জলছাপ
সতেজ ফসল, আনাজপাতি, রান্নার নন্দন—

আলাপ, নীরবতা, আলাপ, নীরবতা
একটি উঠোন থেকে উঠোনে উঠোনে
আলোকরেখায়...

ভোরাই

নতুন ফুটবে বলে চেয়ে চেয়ে
সকালের হয়ে ওঠা দেখি,
আর মিনারের ওপরে দ্যাখো
পাখিয়ানা সুর হয়ে ওঠে,
দূর থেকে ফসলের হাওয়া
ভেসে আসে আমাদের বখে যাওয়া শহরের দিকে
আর হারমোনি খোমক আর
তাল-করতালে ওরা আসে

ওরা আসবে ভোর ভোর
রক্তভেজা পায়ে পায়ে সমুদ্রের দিক থেকে
ইতিহাস নেড়েঘেঁটে জঙ্গলের দিক থেকে আসবে
কিতাব উড়িয়ে উড়িয়ে দু’হাত শূন্যে রেখে
মাঠাবুরুর অন্ধকারের স্মৃতি নিয়ে আসবে ওরা
জবাফুল গলায় প’রে বুকবুক সবুজ হাওয়ায়
চৌকাঠ পার ক’রে ওরা আসবে

এসো হে প্রিয়নাথ বুলবুল, এসো নুরুলের মা
এসো ভরত মণ্ডল, এসো সেলিম চাঁদ, তাপসী বোনটি এসো, এসো মায়া মায়াময়
এসো আজ নতুনের উঠান কাঁপিয়ে
প্রিয়তা বাংলায় কাস্তের ভাষা হয়ে এসো

আজ তোমাদের দিন, আজ সেই সুরে সুরে এসো
যে সুরে ভেঙে যায় ঘুম, চোখের আয়ুষ্কালে
চলো আজ নতমুখে সমবেত হই
হাতমুখ ধুয়ে নিয়ে
সুবহে-সাদিকের নরম আলোয়
হরিজন হরিমুখরতায়

চলো দাঁড়াই
স্বাধীনতা স্বাধীনতা হে কাজল
যা ছিল সতেজ, সহজ বীজের
সোনামণি ধানের মতো
প্রাণবন্ত বিনুনির দুইপাশে
রূপপুর মেলা থেকে কেনা রঙ্গিন ফিঁতার মতো...
চলো গান শুরু করি, চলো লাল-সবুজ জিকির
চলো অন্দরে অন্তরায়—
জানালায় নতুনের হে মুখরা,
আপনার দিন শুরু হোক
ওঠো হে বুলবুল, মায়া, মারিয়ম, সেলিম চাঁদ,
পানির ভিতরে থাকা গোলক ঠাকুর
আলোর সোহাগে ওঠো,
মাটিতে ডাকলা ভোর পাক খেয়ে যায়
তোমার অপেক্ষায় চেয়ে আছে বাংলার নদ,
শস্যের কথামালা, চরাচর, জলছাপ, সুর,
সরস্বতী নদী, বিদ্যা ও বাণিজ্যের অনন্ত ইতিহাস,
আর এই দেহদেশ, দেহের উজান

অলঙ্করণ  শতাব্দী জাহিদ

এ সম্পর্কিত আরও খবর