তবু আমারে দেবো না ভুলিতে

, শিল্প-সাহিত্য

ড. মাহফুজ পারভেজ | 2023-08-31 13:02:46

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের (১৮৯৯-১৯৭৬) ৭৭ বছরের জীবনের প্রথম ৪০ বছর সৃষ্টিমুখর। বাকিটা বেদনার। তাঁর অমর গানের কথাগুলোর মতোই যেন তাঁর ব্যথিত জীবন লিপিবদ্ধ—‘আমি চিরতরে দূরে চলে যাব/তবু আমারে দেবনা ভুলিতে।’

নজরুলকে বিস্মৃত হওয়া বাঙালির পক্ষে আসলেই অসম্ভব। দূরে চলে যাওয়ার অভিমান জানিয়ে কবি নিজেই বলেছেন: ‘আমি বাতাস হইয়া জড়াইব কেশে/বেণী যাবে যবে খুলিতে/তবু আমারে দেবো না ভুলিতে।’

জীবনের মাত্র অর্ধেকের মতো সময়কালে তাঁর তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তা ও বিপুলায়তন সৃষ্টি-সম্ভার বাংলা সাহিত্যে তো বটেই, বিশ্বের বিস্ময়। যে কারণে নজরুল অতুলনীয়, একক এবং সকলের চেয়ে আলাদা বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল।

বিদ্রোহী, প্রতিবাদী, সুন্দরের উপাসক, জাতীয় জাগরণের প্রতিভূ এবং বহুমাত্রিক ঔজ্জ্বল্যে ঋদ্ধ নজরুলের সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ জীবনীর সংখ্যা মুষ্টিমেয়।

রবীন্দ্রনাথের জীবন ও কর্ম নিয়ে রচিত গ্রন্থাবলির সংখ্যাটি বিশাল। মাইকেল মধুসূদনের মতো রহস্যঘেরা প্রতিভারও অনবদ্য জীবনী রচিত হয়েছে গোলাম মুরশিদের কুশলী হাতে, নাম ‘আশার ছলনে ভুলি।’

সবচেয়ে নির্জনতম কবি জীবনানন্দ দাশের জীবনীটিও দুর্লভ্য নয়। মার্কিন অধ্যাপক ক্লিন্টন বি সিলি গভীর অধ্যাবসায়ে তুলে এনেছেন রূপসী বাংলার কবির জীবন ও কীর্তি। তুলনায় নজরুল জীবনী গ্রন্থ অল্পই।

বিভিন্ন জনের, যেমন কমরেড মুজফফর আহমদ, সুফী জুলফিকার হায়দার, আবদুল কাদির, কবি তালিম হোসেন প্রমুখের হাতে নজরুল জীবনের নানা অধ্যায় ও ঘটনার বিচরণ ঘটেছে। পূর্ণাঙ্গ নজরুল জীবনী বলতে যে পরিপূর্ণ ও সামগ্রিক সমীক্ষাকে বোঝায়, তা এখনো অনুপস্থিত।

এক উদ্দাম, প্রাণময়, বাঁধন-ছেঁড়া কবি-সত্তার কিছুটা ছাপ অবশ্যই রয়েছে সেসব রচনায়। কিন্তু প্রামাণ্য জীবনীর বলতে যা চিহ্নিত হয়, নজরুলের ক্ষেত্রে সেটা সামান্যই পাওয়া যায়। নিজের জীবনের মতোই নিজের জীবনীর ক্ষেত্রেও তিনি বেদনাময় পরিস্থিতির যাত্রী।

অবশ্য এ কথাও সত্যি যে, বহুমাত্রিক, বিচিত্রমনা, নিয়ত সৃষ্টিশীল, উদাসী, আবেগী, চলিষ্ণু ব্যক্তিত্বের জীবনী রচনা করাও দুঃসাধ্য। বাংলার সর্ব পশ্চিম প্রান্তে জন্ম নেওয়া এই প্রতিভার মৃত্যু হয়েছে পূর্ব প্রান্তে এবং তিনি বিচরণ করেছেন জগতের নানা স্থানে; যুদ্ধের ময়দানে, সভা-সমাবেশে, ব্যক্তিগত ভ্রমণে দেশ-দেশান্তরে, অসংখ্য নর ও নারীর ভিড়ে কাটিয়েছেন ধূমকেতুর মতো গতিমুখর জীবন।

কত-শত জায়গায় ও প্রতিষ্ঠানে নজরুলের জীবনের নানা আলেখ্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। কত ব্যক্তি মানুষের সত্তা, চেতনা ও ব্যক্তিক আঙিনায় নজরুল রয়েছেন, তা অপরিমাপযোগ্য।

 

ফলে ‘হারানো হিয়ার নিকুঞ্জ পথে’ যে ক’জন দীপ্র প্রতিভার বঙ্গশ্রেষ্ঠকে জাতি বেদনার্ত হৃদয়ে ধারণ করে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে অগ্রণী মুখর ও প্রখর ব্যক্তিত্ব কাজী নজরুল ইসলাম। যার বহুমাত্রিক জ্যোতির্ময় সামগ্রিক জীবনীর অপেক্ষায় সকলেই উন্মুখ।

এ কথাও মানতে হবে যে, একটি বা দু’টি গ্রন্থে নজরুলের জীবন-প্রতিভার সকল দিক তুলে ধরা এবং মূল্যায়ন করা প্রায়-অসম্ভব। তার জীবনের স্বল্পতম সৃষ্টিশীল সময়ে তিনি স্পর্শ করেছিলেন জাতীয় রাজনীতির শীর্ষবিন্দুটিকে। সমাজ ও সংস্কৃতির নানা স্তরে তিনি ভূমিকা রেখেছিলেন পথিকৃতের মতো। ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মেলবন্ধন রচনার প্রয়াসও নিয়েছিলেন সাহসী চিত্তে। সমগ্র বাঙালি জাতিসত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিলেন তিনি এবং এখনো রয়েছেন জাতিসত্তার উত্তরাধিকার রূপে।

পাশাপাশি গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, নাটক ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রেই ঝর্ণাধারার মতো রচনার স্রোত বইয়ে দিয়েছিলেন। বিশেষত, গানে নজরুল একক, অতুলনীয় ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী। সংখ্যায়, কথায়, সুরে, বৈচিত্র্যে, ব্যঞ্জনায় আধুনিক বাংলা সঙ্গীতাঙ্গনে নজরুলের সমকক্ষ আর কেউ নেই।

তবে আশার কথা হলো, নজরুলের কর্ম ও জীবন নিয়ে লেখা অপ্রতুল হলেও একেবারে থেমে নেই। বাংলা সাহিত্যের নিবিষ্ট গবেষকরা এই অসামান্য প্রতিভাধর বাঙালি মনীষার নানা দিককে নানাভাবে পর্যালোচনা ও মূল্যায়নের আলোতে আনছেন।

সর্বসাম্প্রতিক কালে প্রকাশিত ‘নজরুল-জীবনী’ নামে অরুণকুমার বসুর ৭৯৬ পৃষ্ঠার বইটি সে প্রমাণবহ। বইটি পড়ে মনে হলো, নজরুল জীবনীচর্চার ধারায় এটি একটি নবতর সংযোজন।

কারণ এতে রয়েছে প্রাসঙ্গিক বহুতর পাদটীকা ও ব্যাখ্যা, নজরুলরচিত সব কয়টি বইয়ের কালক্রমিক তালিকা, নজরুলকে নিয়ে প্রকাশিত নানা সংকলনের তথ্য, নজরুল বিষয়ক গ্রন্থ তালিকা। আরো একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো বইটিতে ভিন্ন ভাষায় নজরুলচর্চার চমকপ্রদ বিবরণ রয়েছে।

এতসব সংযোজনসমূহ বিরাট কলেবরে প্রকাশের সময় গ্রন্থাকার দ্বিধাহীন চিত্তে যে সত্যটি কবুল করেছেন, তা হলো, তার প্রয়াস পূর্ণাঙ্গ নয়। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, নজরুল বিষয়ে সামগ্রিক জীবনী উপস্থাপন করা, সত্যাসত্য নির্ণয় করা আরো অনেক শ্রম ও সময় সাপেক্ষ। ভবিষ্যতের গবেষকরা এ কাজটি করতে থাকবেন।

আমরাও এমনটি আশা করি এবং বিশ্বাস করি, সমাজ ও রাজনীতি থেকে পদে পদে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে যে নজরুল প্রতিভা ঈর্ষণীয় সৃষ্টির উন্মাদনা নিয়েও বেদনাহত চিত্তে হাহাকার করেছেন, একদিন সেসব ফুটে উঠবে।

ভাগ্যহত ট্র্যাজিক মহানায়কের মতো সকরুণ আর্তিতে নজরুল সাহিত্যের সমান্তরালে তার আলো-ছায়া-ঘেরা জীবনও পরিপূর্ণভাবে উন্মোচিত-উদ্ভাসিত হবে বাংলাভাষী পাঠকের সামনে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর