নজরুল সঙ্গীতশিল্পী ফেরদৌস আরার সাক্ষাৎকার

, শিল্প-সাহিত্য

সাক্ষাৎকার : শিমুল সালাহ্উদ্দিন | 2023-09-01 02:04:38

ফেরদৌস আরা এদেশের নজরুল সঙ্গীতের এক অমোচনীয় নাম। শুধু নিবেদিত প্রাণ গায়কী দিয়ে নয়, নজরুল গবেষণায় ও নজরুলগীতির স্বরলিপি করণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন জনপ্রিয় এ শিল্পী।  জাতীয় কবির জন্মদিন উপলক্ষে তার সাথে আলাপ করেছিলেন ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক, কবি শিমুল সালাহ্উদ্দিন। আলাপচারিতার গুরুত্ব বিবেচনায় হুবহু বিবরণটি রইলো বার্তা২৪-এর পাঠকদের জন্য-

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: আপা কেমন আছেন?

ফেরদৌস আরা: ভালো আছি শিমুল। এতক্ষণ তোমাদের বসিয়ে রাখার জন্য স্যরি। চ্যানেল আই এর একটা রেকর্ডিংয়ে ছিলাম।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: ঠিক আছে আপা। আলাপ শুরু করি। আমার বাবাকে আমি দেখেছি উনি আপনার ভক্ত, আমাদের জেনারেশনে আমরা আপনার ভক্ত, আমাদের পরের জেনারেশনের অনেকেও আপনার ভক্ত। চারদশক ধরে কণ্ঠে ও গ্ল্যামারাস এই অ্যাপিয়ারেন্সে আপনি হাজির হচ্ছেন দর্শকের সামনে। এই চোখধাঁধানো সৌন্দর্য, আবেদনময় গীতভঙ্গি, এর রহস্যটা কী?

ফেরদৌস আরা: তুমি যেভাবে বললে, তাতে তো আমি গর্বিত হয়ে যাচ্ছি। আসলে এমন কোনো আলাদা বিষয় আছে কি না সেটা আমি ঠিক বুঝতে পারি না। তবে আমার মনে হয়, যেটা গ্লো করে সেটা ইনার সাইডের ব্যাপার। আমার যেটা মনে হয় সঙ্গীত নিয়ে, যে কোন কাজ নিয়ে, যদি কোনো মানুষ সাধনায় রত থাকেন অবশ্যই তার একটা অন্য, একটা ডিভাইন বহিঃপ্রকাশ তার অ্যাপিয়ারেন্সে ঘটে। সেটাই হয়তো—যেহেতু গানই আমার জীবন, গানই আমার সবকিছু।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: গানটা শুরু হলো কিভাবে?

ফেরদৌস আরা: আসলে রক্তেই গান। আমার পিতা জনাব এ এইচ এম আবদুল হাই, যদিও ব্যক্তিজীবনে ইন্জিনিয়ার ছিলেন এবং পড়ালেখা করেছেন অবিভক্ত ভারতের সে আমলে এবং উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত নিয়ে তাঁর বিপুল আগ্রহ ছিল। অনেকেই তাঁকে খুবই উঁচুমানের উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত বিশারদ মনে করতেন। তাঁর কাছে আমরা চারবোন এক ভাই, আমাদের হাতে খড়ি।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: আচ্ছা, তার মানে আপনারা চার ভাইবোন ছিলেন পরিবারে—

ফেরদৌস আরা: হ্যাঁ। জীবনের শুরুতে আমার বড়বোনরা ছিলেন, তিনবোন বড়। পরপর তিনটি কন্যা থাকায় আমার বাবা-মা একটি ছেলে হবে বলে আশা করেছিলেন, চতুর্থজন। হলাম আমি। তখন আমার জন্ম। আমার বেড়ে ওঠাটা কিছুটা শার্টপ্যান্ট পরে ছেলেদের মতোন করে দুরন্তভাবে বেড়ে ওঠা।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: জ্বি আপা, আপনি অ্যাথলেট ছিলেন, পুরস্কার জয়ী অ্যাথলেট বিশ্ববিদ্যালয়ে, নাচতেনও।

ফেরদৌস আরা: হ্যাঁ, আমি ইন্টারস্কুল, ইন্টার কলেজ, ইউনিভার্সিটির আন্তঃবিভাগ প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন ছিলাম। মেয়েদের মধ্যে কখনো দ্বিতীয় হইনি। শৈশবের অতিরিক্ত দুরন্তপনাই হয়তো এটার কারণ। আমার বোনরা প্রথমদিকে আর কি, আমি তো তখন গাইতাম না, উনারা যেহেতু গাইতেন মনে করতেন ও নাচ করুক, তা লাফালাফি পছন্দ করে, নাচুক। এভাবেই দুরন্তপনার সাথে বেড়ে ওঠা। বাবার বিভিন্ন জায়গায় পোস্টিংয়ের কারণে অনেক গুণীজনদের সান্নিধ্য পেয়েছি, সেটাও আমাকে আজকের আমি হতে সাহায্য করেছে।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: আচ্ছা। সরকারি চাকরির কারণে। আপনার শৈশব কৈশোর কেটেছে কোথায় বেশি?

ফেরদৌস আরা: কিশোরীকালটা বিশেষত, মানুষের জীবনের সবচেয়ে সোনালী সময়, আমার এটা কেটেছে রাজশাহীতে। রাজশাহীতে অনেক গুণীজন ছিলেন, আমাদের উস্তাদ ছিলেন উস্তাদ আবদুল জব্বার, যিনি বাংলাদেশে, কলকাতায়, আকাশবাণীতে, মহিশুরের গোল্ডমেডালিস্ট, ক্লাসিকাল গাইতেন, অপূর্ব কণ্ঠশৈলী।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: আচ্ছা। রাজশাহীতে থাকতে উনি আসতেন আমার বড়বোনদের শেখাতে। আর উনাকে দেখলেই আমি বেড়িয়ে যেতাম। তখন আমাকে একদিন ধরা হলো ফাঁদ পেতে, কী ব্যাপার উস্তাদজিকে দেখলেই আমি কেনো বেড়িয়ে যাই!

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: মানে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন?

ফেরদৌস আরা: পালিয়ে বেড়াতাম। আমার এখনো মনে আছে, সেই হাফপ্যান্ট পরা কাল। আমাদের  চারবোনেরই প্রচুর চুল। লম্বা কোমরের নিচ পর্যন্ত। কলাবেণী করতাম আমরা সবাই। ছোটমানুষ কিন্তু। উস্তাদজী ধরলেন, যে বোনরা এত গান শেখে, খুব সুন্দর কণ্ঠ তোমার, তুমি কেন শিখতে বসো না। আমি অনেকক্ষণ চুপ থেকে বিরক্ত হয়ে বললাম, উস্তাদজি আমার গান ভালো লাগে না। তিনি বললেন, কেন ভালো লাগে না? আমি বললাম, আপনি আমাকে ছোটদের গান দেন, এটা আমার আসলে ভালো লাগে না। আমি তো বড় হয়ে গেছি। আমার বোনরাসহ সবাই খুব হাসল। আমি ছোট মানুষ, হাফপ্যান্ট পরা, ফ্রক পরা বলছি আমি বড় হয়ে গেছি। তো উনি বললেন, তুমি কী গাইতে ভালোবাসো? আমি চট করে শুনিয়ে দিলাম সন্ধ্যা মুখার্জীর গান।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়? কোন গানটা আপা?

ফেরদৌস আরা: বলছি, আর আমি বললাম, উস্তাদজি আমি তো আপাদের থেকে ভালো গাই। কী যে বাচ্চা আর উদ্ধত ছিলাম। হা হা হা। বলছিলাম যে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের ঐ গান আমি উনার চেয়েও ভালো গাই।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: কোন গানটা আপা মনে আছে?

ফেরদৌস আরা: হ্যাঁ, অবশ্যই। (গান ধরলেন ফেরদৌস আরা) নি সা গা মা পা নি সা রে গা মা/ গা/ গা রে পাখি গা গা/ সোনার শেকল দেবো, সোনার খাঁচা দেবো ভরিয়ে গান/ নি সা গা মা পা নি সা রে গা মা/ গা রে পাখি গা গা/

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: এত শৈশবে এত কঠিন গান?

ফেরদৌস আরা: আমি জানি না কখন শিখেছিলাম। কিন্তু কানে এসেছিল খুব। বড়বোনরা তিনটি মাথা একখানে করে  প্রায় সারাক্ষণ রেডিওতে গান শুনতেন, গান গাইতেন। টেলিভিশন তখনও আসেনি বাংলাদেশে। আমার বোনরা খুবই শুদ্ধতাবাদী ছিলেন। একদম শুদ্ধভাবে স্বরলিপি মেনে কে গায় নজরুল সঙ্গীত তা রেকর্ড করা, লগবইয়ে শিল্পীর নামসহ বাণী তুলে রাখা এসব করতেন আমার বোনেরা। ওদের দেখে দেখে শুনে শুনে আমার সব মুখস্থ হয়ে যেত। আমার বোনেরা কাজ করেছেন, খ্যাতি পাননি কিন্তু এর যে মূল নির্যাসটি সেটি আমি ভোগ করেছি। বড়বোনদের কষ্ট আমার কাছে এসে কাজে লেগেছে। চট করে এই গান শুনে উস্তাদজি বললেন যে আমি তো ভুল করেছি, তুমি ছোট না তুমি বড়। এখন থেকে আমি তোমাকে বড়দের গান দেবো। দেখো তুমি কী গান শিখবে! উনি শেখালেন—ইয়া মোহাম্মদ, বেহেশত হতে, খোদায় পাওয়ার পথ দেখাও—প্রথম গান শেখা, বড়দের গান শিখলাম। এর মধ্যে উস্তাদজিরা সফরে এসেছেন। বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশে ক্লাসিকাল উস্তাদরা আসলেই কিন্তু আব্বাকে খুঁজতেন। আমাদের গানের খবর নিতেন। উস্তাদ সালামত আলী ও নাজাকাত আলী এলেন একবার। তখন উনারা বিশ্ব কাঁপিয়ে বেড়াচ্ছেন ক্লাসিকালে। যুগলবন্দী গাইতেন উনারা। ঢাকায় গান করে উনারা রাজশাহী গেলেন আব্বার উদ্দেশ্যে। ড্রয়িংরুমে সারারাত উনাদের যুগলবন্দী হলো।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: পরিবেশটাই তো অসাধারণ—

ফেরদৌস আরা: একেবারে সাংগীতিক পরিবেশ পেয়েছি আমি। এবং আমার বাসায় এরকম ব্যাপারটা ছিল যে আধুনিক গান কেউ গাইত না। আধুনিক গান গাওয়াটাই একটা মানে অন্যরকম ব্যাপার ছিল। কেউ পছন্দই করত না সবাই রেগে যেত। আর ঐ কাজটাই আমি করতাম। সবাইকে রাগানোর জন্য।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: দুরন্তপনার একশেষ। এই মাত্রার দুষ্টু ছিলেন আপনি!

ফেরদৌস আরা: এত দুষ্টু এত দুষ্টু ছিলাম। যে কাজটি করলে বড়বোনরা বাসা থেকে লাঠিসোটা নিয়ে বের হয় আমি সেটাই করতাম আধুনিক গান গেয়ে গেয়ে। ছোট তো, এতকিছু বুঝিও না সেসময়। সবচেয়ে বেশি যে গানটি গাইলে রেগে যেত সেটা হলো—হানিমুন হানিমুন, দো দিলওকি খুশিওকা নাম হ্যায় হানিমুন।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: চটুল গান, এগুলো কি রেডিওতে শোনা?

ফেরদৌস আরা: হ্যাঁ, রেডিওতে শোনা। এটা গাইলে কী যে রেগে যেত সবাই, ছুটে আসত আমাকে মারতে। ধরতে তো পারত না, খুব মজা পেতাম আমি। এভাবে বেড়ে ওঠা আসলে।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: রাজশাহীর কথা এসব? আপনাদের পাড়া কেমন ছিল?

ফেরদৌস আরা:  রাজশাহীর সব গণ্যমান্য ব্যক্তির বাড়ি কিন্তু পদ্মার তীরে, সব লাইন করে। ডিসি এসপি, জেলার, সিভিল সার্জন সবার। বিশ বাইশ বিঘার একেকটা বাড়ি সেসব। সরকারি বাড়ি। আমাদের যে বাড়িটা সেটা সার্কিট হাউসের ঠিক বিপরীত পাশে ছিল। বিশাল বাড়ি। সামনে অঢেল ফুলের রাজ্য, আমার বাবার খুব পছন্দের। বাড়ির পেছনের অংশটা বাদাম থেকে শুরু করে দারুচিনি, এলাচি, কী নেই, মরিচক্ষেত, শরিষাক্ষেত পর্যন্ত সব আমার মায়ের খুব পছন্দ ছিল। একটা অদ্ভুত সুন্দর পরিবেশ। আমি বলি, রাজশাহীর পরিবেশটি আমাকে এত অনুপ্রাণিত করেছিল যে তার জন্যই আজকের আমি এখনো সবুজ। রাজশাহীতে আমার ঐ সোনালী কিশোরীকাল না কাটলে গানের সাথে আমার এতটা সখ্য হতো কি না জানি না। সেসময় কিন্তু সেখানে উস্তাদ বারীন মজুমদার, রবিউল ইসলাম, আরো অনেক বড় বড় উস্তাদজীরা ছিলেন। আর আব্বা ছিলেন আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে, আমাদের ব্যাকবোন। আমরা গান শিখতাম যা, বাবাই কিন্তু গাইড করতেন, স্টাইলটা বিশেষ করে। এই যে নজরুলের গানের যে একটা বিশেষত্ব আছে, বৈশিষ্ট্য আছে, এটা কিন্তু আমার পিতার কাছে পাওয়া।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: ধ্রুপদী একটা সঙ্গীত পরিমণ্ডলে থেকে নজরুল সঙ্গীতের প্রতি আপনার এই আগ্রহটা কিভাবে তৈরি হলো?

ফেরদৌস আরা: এটা খুব স্বতঃস্ফূর্তভাবে হয়েছে। কখন যে হয়েছে বলতে পারব না। খেলাধুলা দুষ্টুমির ভেতর দিয়েই কখন যে গানের মধ্যে এসেছি এটা ঠিক আলাদা করে বলতে পারি না। বয়সের সাথে সাথে বুঝতে পারলাম, যে গান আমাকে সবচেয়ে বেশি টানে সেটা নজরুলের গান, ক্লাসিকাল সেমি ক্লাসিকাল নজরুলের গান। তারও আগে যদি বলি, আমার আব্বার তখন পোস্টিং চিটাগং, আমার মনে আছে বড়বোনরা গান শিখতে যেতেন সঙ্গীত পরিষদে, উস্তাদ চুলুবাবু ছিলেন, নীরদবরন বড়ুয়া ছিলেন, মিহির লালা ছিলেন—আরো অনেক নামকরা উস্তাদজীরা ছিলেন। তো, ঐ সময়ে বড় বোনরা শিখতে যেতেন আমি যেতাম খেলতে। কিন্তু এখন বুঝি, ওটা আমি খেলতে যেতাম না আসলে খেলা পণ্ড করতে যেতাম। সঙ্গীত পরিষদের গরাদটা অনেক উঁচুতে, খেলতে খেলতে কখন যেন, বাইরে থেকে, গরাদটা অনেক উঁচুতে, লাফ দিয়ে জাম্প করে ধরতাম শিক, তখন ভেতরে শেখাচ্ছেন উস্তাদজীরা, তখন সুয়োরানী দুয়োরানী নামে একটা নাটকের মহড়া হচ্ছে। আমার বড়বোন রানীর অভিনয় করেছেন, তো বড়োরানী বড় অবহেলিত, তিনি গাইছেন, আমার দুখের নিশি, শেষ হলো কি আজি এ প্রভাতে! সেই চিটাগং থেকে চলে এলাম ঢাকায়, ঢাকা থেকে রাজশাহী। তারপর ফিরে এলাম আবার ঢাকায়। আমার তখনও কিশোরী বেলা যায়নি। একাত্তর সালে আমরা ঢাকায় এলাম। তার আগে থেকেই তো অস্থিতিশীল পরিস্থিতি। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা পালিয়ে গেলাম রাজশাহীর তানোরে।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: তানোরে তো সাঁওতালরা আছেন।

ফেরদৌস আরা: হ্যাঁ, সাঁওতালদের দেখে এসেছি। এই যে পরিবেশগুলো নিজের চোখে দেখা এসবও আমার দেখার জগৎটাকে বড় করেছে। সাঁওতালদের পরিবেশে, তখন তো ছোটসময়, তখন বুঝিনি, কতটা প্রভাবিত আমি। পরে আমি জানলাম, এই আমি যাকে আদর্শ বলে মানি, আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রতিটি গানে, বিশেষ করে কয়লার খনিতে যে উপজাতিরা কাজ করেছে, কয়লা খনিতে যে সাঁওতালরা কাজ করেছে, নজরুল ঝুমুর অঙ্গের গানে তাদের তাল সুর কাজে লাগিয়ে দিয়েছেন—(ফেরদৌস আরা গাইছেন), নাচের নেশার ঘোর লেগেছে নয়ন পড়ে ঢুলে লো, নয়ন পড়ে ঢুলে। এই যে এতো সুন্দর গান—

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: বাহ্। আপা এটা তো ঝুমুর অঙ্গের গান, নজরুল গানে—

ফেরদৌস আরা: গজল ঢুকেছে, একটা নতুন অঙ্গন তৈরি হয়েছে। তার বাইশ বছর কি তার একটু বেশি কর্মময় জীবন, সবরকমের রচনায় তিনি সাফল্যের তুঙ্গ স্পর্শ করেছেন। তিনি নিজে সাংবাদিক ছিলেন, তিনি প্রেমের কবি, বিদ্রোহের কবি, তিনি বিদ্রোহীর মতো একটি কবিতা লিখেছেন যে কবিতা পড়ে তখনকার দিনে খ্যাতির মধ্যগগনে যিনি অবস্থান করছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাকে কবি বলে সম্বোধন করলেন—

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: বটেই আনন্দময়ীর আগমনে লেখার জন্য জেলও খাটলেন নজরুল, আর রবীন্দ্রনাথ জেলে চিঠিও লিখলেন—

ফেরদৌস আরা: হ্যাঁ। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যখন কবি বললেন তখন রবিবাবুর চারিদিকে আর যারা ছিলেন কবি তারা তো ফুঁসে উঠলেন, এই চাল নেই চুলো নেই ছন্নছাড়া লোক কবি হলে আমরা কী! এই ভবঘুরে বাউন্ডুলে এনাকে আপনি কবি বললেন? তো তিনি তাদের বললেন, শোনা কথা, বলছিলেন যে, বিদ্রোহীর মতো কবিতা এ বয়সে যে লিখেছে সে কবি নয়, মহাকবি।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: কখন আপনি বুঝতে শিখলেন যে গানটা আমার প্রাণের সাথে যায় এবং আমি গান গাইব? সেটা আসলে কোন পিরিয়ড? সেটা কি ঢাকায় আসার পর?

ফেরদৌস আরা: ঠিক গানই গাইব এমন একটা শপথ নিয়ে তো গান গাইতে আসিনি। তবে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের একটা পরিবেশ, বোনদের গান গাওয়া এসব আমাকে প্রভাবিত করেছে। গান আসলে এমন জিনিস এটা হয়, এটা করা যায় না। প্রেমের মতোই। প্রাণ থেকে আসা। আমার গানও তাই। যেটা করা যায় সেটা হলো সাধনা।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: নজরুলের গানের সুর যেরকম প্রভাবসঞ্চারী, প্রচণ্ড রকম শক্তিশালী, বাণীও তাই। আপনি আসলে বেশি প্রেমে পড়েছিলেন কোনটার?

ফেরদৌস আরা: তার বৈচিত্রের। সুরের বৈচিত্র এবং কথার বৈচিত্র। বাঙালি কিন্তু বৈচিত্র্য প্রচণ্ড ভালোবাসে।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: নজরুলের গানে বৈচিত্র ব্যাপারটা কি ব্যখ্যা করা যায় আপা?

ফেরদৌস আরা: নজরুলের গানে এত রকম বৈচিত্র্য আছে, আমি ভেবে দেখেছি, তার মধ্যে আছে সুরের বৈচিত্র্য, লেখনীর বৈচিত্র্য, আঙ্গিকের বৈচিত্র্য। একটি বিষয়ে যদি তিনি ঢুকেছেন, ইসলামী গানে আপনি যান দেখবেন সেখানে হামদ নাত শুধু নয় সবরকমের কথা সেখানে আছে। মুসলিম নারী জাগরণের জন্য নারী শিক্ষার জন্য নজরুল লিখেছেন, সুর করেছেন। বোরখা উতারি বাহিরিয়া আসো, এটা প্রতীকী একটা কথা, এই বোরখা সেই বোরখা নয়, জ্ঞানের যে আবরণ—

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: অন্ধকার কালোর যে আবরণ ওটা ছেড়ে বেরিয়ে আসো।

ফেরদৌস আরা: রাইট। মানে নারীদেরও যে কত রকমের অধিকার আছে, নেবার ব্যাপার আছে, কত জ্ঞান দেবার ব্যাপার আছে তা বলেছেন তিনি। যদি হিন্দু মিথে ব্যবহার দেখি আমরা শ্যামাসঙ্গীতে, তো দেখবেন কী দুর্দান্ত কাজ নজরুল করেছেন। আমি বলি—যে কবি রোজায়ও আছেন পূজায়ও আছেন, বাঙালির সবরকম চেতনায় আছেন, যে কবি বছরের তিনশো পঁয়ষট্টিদিনের প্রতিটি মুহূর্তের কথা লিখে গেছেন, এবং দেখেন কত কম সময়ে, তার সৃষ্টকর্মের সময় দিয়ে যদি রচনাগুলিকে আমরা ভাগ করি, দেখব প্রতিমুর্হূর্তেই তিনি সৃজনশীল। হয়তো কোনো কোনো সময় একসাথে দুটি তিনটি লেখা বা গান তিনি লিখেছেন।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: বাহ্। আপা আপনার গায়কীতে কার প্রভাব সবচেয়ে বেশি। আপনার আগে ফিরোজা বেগম বা সুধীন দাশ কারো কোন প্রভাব কি আছে?

ফেরদৌস আরা: অবশ্যই প্রভাব আছে। হান্ড্রেড পারসেন্ট প্রভাব আছে আমার পিতার। সঙ্গীত এমন একটি ব্যাপার, যারা শেখান তাদের কাছে শিক্ষার্থীরা প্রভাবিত হনই। আমিও হয়েছি। সবচেয়ে বেশি হয়েছি আমার বড়বোনের কাছ থেকে, এবং তাদের কাছে আমি ঋণী। আমার সবচেয়ে বড় বোন ছিলেন হুরী জান্নাত, হিরণ আলম নামে পরিচিত। মেজো বোন, উস্তাদ মীর কাসিম খাঁ সাহেবের ছাত্রী, সেতার বাদক, মেজো বোন নুরী জান্নাত। জান্নাত আরা হচ্ছেন আমার ইমিডিয়েট বড়। যিনি বাংলাদেশের একজন স্বনামধন্যা গায়িকা। আনফরচুনেটলি আমি দুবোনকে হারিয়েছি। এছাড়াও আমি বিভিন্ন জেলায় অনেক গুণীজনের সান্নিধ্যে এসেছি। রাজশাহী থেকে ঢাকায় আসার পর আমি শিখতে শুরু করি উস্তাদ কাদির জাবেরীর কাছে, আমাদের দেশের অনেক প্রখ্যাত শিল্পীরা উনার কাছে তালিম নিয়েছেন।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: আপা, আপনাকেও অনেক নজরুল সঙ্গীত শিল্পীরা অনুসরণ করেন। আপনার একটি বিশেষ ধরনের গায়কী আছে। তবে, একজন শিল্পী তো সবার আগে নিজে শ্রোতা। কারণ তার কানদুটিই তার মুখের সবচেয়ে কাছে থাকে। আপনি কী কী বৈশিষ্ট্য টের পান আপনার গায়কীতে আপা?

ফেরদৌস আরা: অনেকেই বলে থাকেন, অনেক সময় লাইভে, স্ক্রিনে বসেও দেখেছি, অনেকেই বলেন, নজরুলের যে আঙ্গিকের গানই আমি গাই, সে আঙ্গিকের বৈশিষ্ট্য, চরিত্রটি আমার গানে আমার ভঙ্গিতে, অনেকে বলেন, আমার চোখে মুখে ফুটে ওঠে। আমি ঠিক নিজে বুঝতে পারি না।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: চোখে মুখে যে ফুটে ওঠে সেটাই তো নিবেদন, আমি সে নিবেদনের কথাই জানতে চাচ্ছি।

ফেরদৌস আরা: এই জিনিসটা আমি দেখেছি, বিশেষ করে আমার কাছ যারা শিখতে আসে, আমার প্রতিষ্ঠান সুরসপ্তকে, এটি আমি ২০০০ সালে গড়েছি, আমার গড়ার যে খুব ইচ্ছে ছিল তা না, আমার সারাজীবনই মনে হয়েছে আমি তো শিক্ষার্থী, আমি শিখতে থাকব, শেখাবোই বা কী! কিন্তু অনেক ছাত্রছাত্রীর পীড়াপীড়ি ও অনুরোধে আমি শুরু করলাম। তারপর থেকে এই ষোল বছর চলছে আমি শেখাচ্ছি। অসংখ্য স্টুডেন্টদের ভালোবাসা, শ্রদ্ধা আমি পাচ্ছি। আমি মনে করি আমার সারাজীবনের যে নিবেদন এর চেয়ে বড় অ্যাওয়ার্ড আর হয় না।

(দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের নির্বাচিত অংশ)

এ সম্পর্কিত আরও খবর