আল মাহমুদ, প্রেমবাদ ও ইমাম খোমেনি

বিশেষ রচনা, শিল্প-সাহিত্য

সৈয়দ তারিক | 2023-08-31 23:57:13

এ লেখার একটি মজাদার আপতিক কারণ রয়েছে।
আমার অনুজাপ্রতিম কবিবন্ধু নভেরা হোসেন সেলফোনে বললেন, ‘তারিক ভাই, বইমেলায় গিয়ে আপনার বই কিনলাম। পরে দেখি যে, ওপরে আপনার বইয়ের কভার, ভেতরে আল মাহমুদের কবিতা।’ আমি খুব কৌতুক বোধ করলাম। কবি আল মাহমুদের সঙ্গে এক প্রকার আধিদৈবিক আত্মীয়তার বিরল আস্বাদ পেলাম যেন। তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা স্মৃতিগুলো অবিরল পাপড়ি মেলতে থাকল।

আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে কবি আল মাহমুদের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। আমি তখন নিতান্ত যুবক। ‘সোনালি কাবিন’ সনেটগুচ্ছ নিয়ে একটা আলোচনা লিখেছিলাম ‘একবিংশ’ পত্রিকায়। তিনি লেখাটির প্রশংসা করেছিলেন। তিনি তখন শিল্পকলা একাডেমিতে চাকরি করেন। মাঝে মধ্যেই চলে যেতাম তার দপ্তরে। চা খাওয়াতেন। বেনসন অ্যান্ড হেজেসের প্যাকেট খুলে দিতেন। আর, অনর্গল কথা বলতেন সাহিত্য নিয়ে, তার কবিবন্ধুদের নিয়ে, তার জীবনের নানা ঘটনা নিয়ে এবং ধর্ম নিয়ে। তার রচনার মতো তার কণ্ঠেও উত্তাপ আছে। শামসুর রাহমান এবং আল মাহমুদ—এ দুটি নাম প্রায়ই একসঙ্গে উচ্চারিত হয়। সব তুলনাই সরলীকরণ ও বিভ্রান্তির দিকে নিয়ে যেতে পারে। তবু বলা যায়, শামসুর রাহমানের কবিতার মতো ব্যক্তি শামসুর রাহমানও তুলনামূলকভাবে অধিকতর নাগরিক ও বিদগ্ধ এবং আল মাহমুদের কবিতার মতো ব্যক্তি আল মাহমুদও অধিকতর লোকায়ত ও ভাবপ্রবণ। এ দুই কবি—যারা এককালে বন্ধু ছিলেন, একসময় পরস্পর বিপরীত অবস্থানে চলে যান। আল মাহমুদ সে-বিষয় নিয়েও নানারকম কথা বলতেন। অনেকটা সময় পার হলে তারপর উঠতে চাইলেও উঠতে দিতেন না। সিগারেটের প্যাকেট এগিয়ে দিতেন—‘বসো, সিগারেট খাও।’ কোনো-কোনো দিন অফিসের সময় শেষ হয়ে যেত। উনি উঠতেন। বলতেন, ‘আজ গাড়িতে যাব না। চলো হাঁটি।’ তার সঙ্গে বেরিয়ে পড়তাম। রমনা পার্কের পাশ দিয়ে হেঁটে মগবাজারের দিকে চলে যেতাম। তিনি তখন ওই এলাকার মীরবাগে থাকতেন। গল্প করতে করতে দুপুরের রোদ ভেঙে আমরা চলতে থাকতাম।

একদিন তার বাসায় গেলাম বিকেলে। গল্প হলো। চা-নাশতা খাওয়া হলো। তারপর তিনি বললেন, ‘আমি একটু বাজারে যাব। তুমি বসতেও পারো, আমার সঙ্গে আসতেও পারো।’ আমি বললাম, ‘নিশ্চয়ই সঙ্গে যাব। কবির বাজার করা দেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে চাই না।’ তিনি বাজার করলেন। শাকসবজি, বড়-বড় চিংড়ি মাছ এবং গরুর গোস্ত কিনলেন। বাজার শেষ হলে বললেন, ‘চলো, আরো গল্প করা যাক।’ আবার গেলাম তার বাসায়। একসময় উঠতে চাইলে বললেন, ‘না, এখন যেতে পারবে না। রান্না হচ্ছে, খেয়ে তারপর যাবে।’ সেদিন তার সঙ্গে ভূরিভোজ করতে হয়েছিল।

অনেকদিন হলো সাহিত্যিক পরিমণ্ডলের সঙ্গে আমার যোগাযোগ ক্ষীণ। শ্রদ্ধেয় কবি আল মাহমুদের সঙ্গেও দেড় দশকের বেশি কাল ধরে কোনো যোগাযোগ নেই। তার লেখাও পড়া হয় না বহুদিন। এমনই সময়ে নভেরা নস্টালজিয়ার উপলক্ষ দিল আমাকে। 

২.
সে বছর (২০০৯) বইমেলায় আমার একটি কবিতার বই বের হয়েছে। মাওলা ব্রাদার্স প্রকাশ করেছে সেটা। বইটির নাম ‘মগ্ন তখন মোরাকাবায়’। সৈয়দ মুজতবা আলীর দৃষ্টান্তে আমি মাঝে মধ্যে বইটি কিনি একে-ওকে-তাকে উপহার দেওয়ার জন্য। ও রকম কিনতে গিয়ে আমার হাতেও পড়ল একটা কপি, যার প্রচ্ছদে ‘মগ্ন তখন মোরাকাবায়’ আর ভেতরে আল মাহমুদের ‘প্রেমের কবিতা সমগ্র’। বাঁধাইখানার নিতান্ত বিভ্রাট। তবু এরই ফলে অনেকদিন পর আল মাহমুদের কবিতা (আবার) পড়ার সুযোগ পাওয়া গেল।

কবিরা প্রায় সবাই প্রেমের কবিতা লেখেন। যদি কেউ বলেন যে, সব কবিতাই প্রেমের কবিতা, তা-ও অবশ্যই মান্য। প্রেমই জন্মস্থান, সৃষ্টির আঁতুরঘর। ঘৃণা বা দ্রোহ তো প্রেমেরই বিপরীত প্রকাশ, সৌন্দর্য তো প্রেমেরই অলঙ্কার। তারপরও কিছু কিছু কবিতা বিশেষভাবেই প্রেমের কবিতার তিলক কপালে আঁকে। প্রেমের কবিতার বিশেষ সঙ্কলন হয়।

প্রেম কী?

প্রেম হচ্ছে দুটি সত্তার মধ্যে আত্যন্তিক আকর্ষণ—যে আকর্ষণ বিশ্বজাগতিক প্রধান সত্য। যে চারটি বল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে কাজ করে (অভিকর্ষ, তড়িৎ-চৌম্বক বল, স্ট্রং ফোর্স ও উইক ফোর্স) তার সবই আকর্ষণমূলক। সবরকম ইতিবাচক মানবিক সম্পর্কের মধ্যেই ভালোবাসা আছে, তবু প্রেম বলতে প্রচলিতার্থে নর-নারীর পারস্পরিক আকর্ষণ বোঝায়। এর পেছনে দৈহিক প্রণোদনা নিশ্চয়ই একটি প্রধান নিয়ামক, তবু ভালোবাসা কেবল ভোগাকাঙ্ক্ষার মধ্যেই সীমিত নয়। দুটি সত্তার ঐক্য উপলব্ধির অভিপ্রায় নিহিত থাকে এর মধ্যে। দুটি মানুষ পরস্পরের পরিপূরক হয়ে জীবনযাপন করতে চায়। প্লেটোর প্রেমতত্ত্ব বলছে, মানুষরা আগে ছিল পরস্পর সংযুক্ত, দেবরাজ জিউস তার তরবারিতে দ্বিখণ্ডিত করলেন তাদের। আর তাই নিজের বাকি আধখানাকে ফিরে পাওয়ার জন্য মানুষ অন্যকে ভালোবাসে। এর মধ্যে রূপক সত্য এই যে, মানুষ নিজের সত্তার অপূর্ণতাকে অনুভব করে এবং সেটিকে পূর্ণ করতে চায় অন্য একটি সত্তার সঙ্গে সম্মিলিত হয়ে। নর-নারীর প্রেমেই এর সাধারণ প্রকাশ। কিন্তু এখানে জাগতিক অর্থে চাওয়া-পাওয়ার ব্যাপার থাকে। পরস্পরের দেহভোগের আকাঙ্ক্ষা থাকে। পরস্পরের কাছ থেকে নানা রকম সুবিধা পাওয়ার ব্যাপার থাকে। কিন্তু এই প্রেমের জন্যই মানুষ কী না করতে পারে! পরিত্যাগ করতে পারে জাগতিক সম্পদ ও সাফল্য, যেমন অষ্টম এডওয়ার্ড করেছিলেন সাম্রাজ্যত্যাগ। এই প্রেমেরই জন্য যুবকরা হয়ে ওঠে উন্মার্গী—লায়লীর প্রেমিক কায়েস যার দৃষ্টান্ত। এই প্রেমে পড়েই যুবকেরা কবি হয়ে ওঠে আর পৃথিবীর মানুষরা তাদের হৃদয়ের কথাগুলো শুনতে পায় অমর পঙক্তিমালায়।

কিন্তু এই সাধারণ ও সঙ্কীর্ণ সম্পর্কের বাইরে রয়েছে উচ্চতর ও গভীরতর প্রেমের আদর্শ, যেখানে সীমিত ব্যক্তিসত্তা পূর্ণসত্তার সঙ্গে প্রণয়ে ব্যাকুল। জালালউদ্দিন রুমির পবিত্র ‘মসনবি’র শুরুতেই এই ব্যাকুল কান্নার কথা আছে, বাঁশির মর্মবেদনায়। আপন সত্তার অপূর্ণতা যে অনুভব করে সে খোঁজে পূর্ণতাকে। এই পূর্ণসত্তাকে মানুষ দেশ-কাল-সংস্কৃতি ভেদে নানারকম নাম দেয়। মানুষ প্রথমত ইন্দ্রিয়নির্ভর। ইন্দ্রিয় তাকে বাহ্যবস্তুর দিকেই নিবিষ্ট রাখে এবং পূর্ণসত্তাকে সেই বাহ্যিক জগতের দূরতম অধিবাসী ধরে নেয়। কিন্তু গভীর অনুধ্যান তাকে শেখায় যে পূর্ণসত্তা ব্যক্তির চেতনার গভীরেই নিহিত। অপূর্ণ সত্তার নাম দেওয়া হয় ‘জীবাত্মা’, ‘নফ্স’, ‘কাঁচা আমি’, ‘ছোট আমি’ এবং পূর্ণ সত্তার অভিধা হলো ‘পরমাত্মা’, ‘রুহ’, ‘পাকা আমি’, ‘বড় আমি’ ইত্যাদি। এই অপূর্ণ সত্তার একমাত্র বাসনা আপন সত্তার সীমা অতিক্রম করে সত্তার পূর্ণতা লাভ করা। এই পূর্ণতা লাভ করার যে প্রক্রিয়া, দেশ-কাল-সমাজ-সংস্কৃতি-দর্শন প্রভৃতির আপেক্ষিকতায় তার বিভিন্ন নাম হয়; কিন্তু মূলগতভাবে সবাই অভিন্ন দর্শনের অনুসারী। ইসলাম ধর্মের কাঠামোয় এ পদ্ধতির নাম সুফিবাদ বা ফকিরি বা তাসাউফ বা মারেফতপন্থা ইত্যাদি। এ পথচারিতার জন্য মুরশিদ বা গুরুর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরম সত্তার বাস্তব প্রতিভূ হিসেবে মুরশিদ বা গুরুর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলতে হয়। অহম থেকে মুক্তির জন্য এটা খুবই দরকারি। মুরশিদের সঙ্গে এই সম্পর্ক প্রেমের নতুন তাৎপর্য দেয়।

আধ্যাত্মিক সাধকরা সাধনার অংশ হিসেবে এবং/অথবা ভাবধারা প্রকাশের লক্ষ্যে গানে ও কবিতায় যেসব বাণী রচনা করেছেন, তার মধ্যে প্রেম একটি প্রধান অনুষঙ্গ। ‘চর্যাপদ’-এ এক অন্ত্যজ রমণীর উল্লেখ রয়েছে ‘ডোমনি’, ‘চণ্ডালিনী’ ইত্যাদি নামে—যদিও তা আন্তরসত্তার রূপক বর্ণনা। বৈষ্ণব পদাবলিতে রাধা ও কৃষ্ণের মিলন ও বিরহ এবং এর নানা অনুষঙ্গ বাঙালির হৃদয়ের কীর্তন। এই রাধাকৃষ্ণ জীবাত্মা বা নফ্স বা জৈবপ্রবৃত্তি এবং পরমাত্মা বা রুহ বা বিশুদ্ধ সত্তার প্রতীক। রোমান্স কাব্যগুলোতে প্রেমকাহিনীর রূপকে জীবাত্মার দিব্যাভিসারের কাহিনী আমরা পাঠ করি। পরম সত্তার প্রতি প্রণয়াকাঙ্ক্ষা মানুষকে সার্বিকভাবে মানবপ্রেমিক করে তোলে। কারণ সাধক জানেন ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’ এই প্রেমের বাণী আমরা শুনতে পাই কবিরের দোঁহায়, শাহ আবদুল লতিফ ভিটাইর কাব্যে, মীর তকি মীরের গজলে, মীরা বাঈয়ের ভজনে, আমির খসরুর কাওয়ালিতে। এই প্রেমের বাণী আমরা পাঠ করি জালালউদ্দিন রুমি, হাফিজ, জামি, সাদি, খৈয়ামের কাব্যে, ইকবালের দর্শনস্নিগ্ধ কবিতাবলিতে। এই প্রেমের বাণী আমরা হৃদয় মেলে শুনি রবীন্দ্রনাথ-নজরুল ইসলাম-ডি এল রায়-অতুল প্রসাদ-রজনীকান্ত সেনের অমর সঙ্গীতমালায়। এই প্রেমের বাণী আমরা শুনতে পাই ফকির লালন সাঁই ও হাছন রাজার মহৎ কালামগুলোতে। এই প্রেমে জাগতিক তুচ্ছতা থেকে আধ্যাত্মিক অপার সৌন্দর্যের হাতছানি; এই প্রেমে ব্যক্তির অহমকেন্দ্রিক ও ভোগলিপ্সু সঙ্কীর্ণ দুনিয়াদারির জীবন থেকে উদার, সর্বজনীন ও মহামানবিক দিব্য জীবনের আহ্বান—যে প্রেমের চর্যা দুনিয়াকেই স্বর্গে পরিণত করে। কবির আধ্যাত্মিক দর্শন থাকলে দেখা যায়, সাধারণ প্রেমের কবিতাতেই আধ্যাত্মিক সত্যের প্রকাশ ঘটেছে। ‘গীতবিতান’-এর ‘প্রেম’ এবং ‘পূজা’ পর্যায়ের অনেক কবিতাই স্থানান্তরযোগ্য।

আল মাহমুদ—বেদনার বিষয়—সেই ধারার কবি নন। অথচ তারই ছিল সম্ভাবনা এই ধারার সার্থক কবি হওয়ার। সেই ১৯৭৪ সালে যখন ‘গণকণ্ঠ’ নিষিদ্ধ হলো এবং এই পত্রিকার তৎকালীন সম্পাদক আল মাহমুদ—যিনি ‘সোনালী কাবিন’-এর রচয়িতা—কারাবন্দি হলেন, তিনি একদিন ‘ইসলামি কবি’ হয়ে উঠলেন। তার সঙ্গে সান্নিধ্যের কালে তাকে বলতে শুনেছি, কেউ কেউ তার নামে অপপ্রচার করে যে, তিনি পেট্রোডলার পেয়ে ভোল পাল্টেছেন; কিন্তু সত্য হচ্ছে যে, তিনি জেলে থাকা অবস্থায় পবিত্র ‘কোরআন’ পাঠ করে এর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হন। ঘটনা হচ্ছে এই যে, সে সময় থেকে আজ অবধি যেসব ধর্মভিত্তিক গোষ্ঠী ও সংগঠনের সঙ্গে তার কুটুম্বতা তাদের ইসলামের সামাজিক, রাজনৈতিক ও বাহ্যিক আচরণিক দিক নিয়েই প্রধান কায়কারবার এবং এদের কোনো কোনো অংশ উদার মানবিকতা, সহনশীলতা ও সর্বজনীনতার বিপক্ষ শক্তিও বটে। নিশ্চয়ই পছন্দের এখতিয়ার তার ছিল এবং তা আসলে তার তকদির। তবু যদি তিনি ইসলামের অন্তরে নিহিত মৌল সত্য, সৌন্দর্য ও পদ্ধতির অনুসারী হতেন, যদি তিনি সুফিবাদকে একান্তভাবে গ্রহণ করতেন, তবে হয়তো বাংলা ভাষার একজন মহৎ মর্মবাদী কবিকে আমরা পেতাম এবং তার বাণী আমাদের আধ্যাত্মিক অগ্রযাত্রায় সহযোগী কালাম হয়ে উঠত। কারণ সুফিবাদ শেখায় মানবপ্রেমই ধর্মের মৌল আচরণ, সুফিবাদ শেখায় ধৈর্য ও সহিষ্ণুতাই ধর্মের প্রধান শিক্ষা। বিশেষত, এই মৌলবাদী (ভাস্কর্যও এ দেশে ভেঙে ফেলা হয় ‘মূর্তি’ অপবাদ দিয়ে!), উগ্রবাদী (একে-ওকে-তাকে ‘মুরতাদ’ বা ‘কাফের’ ফতোয়া দিয়ে কী নৈরাজ্যিক পরিবেশ সৃষ্টি করে তারা!) ও জঙ্গিবাদী (কী ভয়ঙ্কর রক্তলোলুপ বীভৎসতা শান্তি ও আত্মসমর্পণের ধর্ম ইসলামের নামে!) অপতৎপরতার যুগে প্রেমবাদের চর্চা খুবই অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। তার ‘প্রেমের কবিতা সমগ্র’র মধ্যে নির্জনে অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে ‘কৃষ্ণকীর্তন’ ও ‘নেকাব’-এর মতো কোনো-কোনো কবিতা এবং চমক দেয় সম্ভাবনার।

৩.
এ বইয়ে আল মাহমুদ অনূদিত কয়েকটি বিদেশি কবিতার অনুবাদও সঙ্কলিত হয়েছে। তার মধ্যে একটি হলো আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির ‘গজল’ শীর্ষক কবিতা। কবিতাটি সুন্দর। সুফি ভাবধারায় লিখিত। এটি পড়লে মনেই হবে না যে, তিনি ইরানের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী সেই রাষ্ট্রবিধাতা। এটা পড়লে মনেই হবে না যে, এর রচয়িতা তিনি, যিনি সালমান রুশদি নামের লেখক একটি উপন্যাস লেখায় তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ সৃষ্টি করেছিলেন লেখককে কেউ হত্যা করতে পারলে তাকে বিশাল অঙ্কের পারিতোষিক দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে। কোনো লেখা যদি গ্রহণযোগ্য না হয় তবে নিশ্চয়ই তার সমালোচনা করে অন্য লেখা তৈরি হতে পারে। কিন্তু কোনো লেখককে হত্যার জন্য পুরস্কার ঘোষণা কী করে একজন ‘নিরাসক্ত পীরের মোটা আলখাল্লা পরা’ লোক করতে পারে, তা বিস্ময়কর। কারণ সুফিবাদ প্রেমের, ধৈর্যের ও ক্ষমার পথ।

মুসলমানদের কোনো কোনো গোষ্ঠীর মধ্যে সহনশীলতা খুবই কম। এরা কেউ কেউ বড় পীর মহিউদ্দিন আবদুল কাদের জিলানি, হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালি, মাওলানা জালালউদ্দিন রুমি, মহিউদ্দিন ইবনুল আরাবি এবং আহমদ রেফায়িকে ‘খামসায়ে কাফেরে আকবর’ বা ‘পাঁচজন শ্রেষ্ঠ কাফের’ বলে ফতোয়া দিয়েছিল। এরাই কেউ কেউ আল্লামা ইকবালকে কাফের ফতোয়া দিয়েছিল। এরাই কেউ কেউ কাজী নজরুল ইসলামকে কাফের ফতোয়া দিয়েছিল (ইতিহাসের কী বিদ্রুপ, আজ তারাই কেউ কেউ নজরুলকে ‘নায়েবে রসুল’ বলে থাকে)। এসব ফতোয়ার কারণে ধর্মে জমেছে ক্লেদ, সভ্যতায় লেগেছে আঘাত।

প্রসঙ্গত উল্লেখ করি, ১৯৮৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে যখন রুশদি রচিত ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’-এর বিরুদ্ধে ইমাম খোমেনির ফতোয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সারা পৃথিবীতে ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম শুরু হয় ও দেশে দেশে নিষিদ্ধ হয় বইটি, তখন আমরা, বাংলাদেশের ২০ জন তরুণ লেখক-কবি একটি যৌথ বিবৃতি দিয়েছিলাম। যার মূল বক্তব্য ছিল এই যে, কোনো সৃজনশীল লেখককে নিষিদ্ধ করা উচিত নয় এবং তাকে হত্যা করার নির্দেশ ও উৎসাহ সভ্যতাবিরোধী। এর ফলে আমরা এ-দেশি মৌলবাদীদের রোষের মুখে পড়েছিলাম।

আজ বলতে পারি, কোনো লেখকেরও উচিত নয়, যে-ব্যক্তিকে পৃথিবীর নানা স্তরের মানুষ শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে, তাকে সাহিত্যকর্মে এমনভাবে উপস্থাপন করা, যা মানুষের মনে গুরুতর আঘাত করে। এটাও মানবিক সম্প্রীতির পরিপন্থী।

তারপরও জিজ্ঞাসা জাগে, এই হত্যার নির্দেশ দেওয়া তার পক্ষে কেমন করে সম্ভব যিনি লিখতে পারেন :
‘মসজিদ আর মাদ্রাসার প্রতি আমি বেজার
আমি দেহ থেকে খুলে ফেলেছি খোদাভীতি
ও লোকদেখানো ধার্মিকতার পোশাক।
এবং পরে নিয়েছি নিরাসক্ত পীরের মোটা আলখাল্লা, শালীন।
বকবাজ শহুরে মোল্লাদের উপদেশে আমি তিতিবিরক্ত।
আর সাহায্যটুকু তো মদাসক্ত মাতালের নিঃশ্বাস থেকেই আমি পেয়েছি।’

সংযোজন :

ওপরের লেখাটি তৈরি হয়েছিল ২০০৯ সালে। তারও কয়েক বছর পরে, ২০১৩ সালে, আল মাহমুদ-এর সাথে শেষবার দেখা হয়েছে ‘নতুনধারা’ সাহিত্য পত্রিকা আয়োজিত কবিতা পাঠের আসরে। বয়সের ভারে তিনি ক্লান্ত। তার সাথে করমর্দন করে বললাম, ‘মাহমুদ ভাই, আমি সৈয়দ তারিক।’ তিনি যেন কোনো সুদূর কালের অন্তর হতে ধীর স্বরে বললেন, ‘অনেক আগে সৈয়দ তারিককে আমি চিনতাম।’

এর কয়েক বছর পর তিনি পার্থিবতা ঘোচালেন। একদিকে কবিতায় ও গল্পে তার অসাধারণ অবদান অন্যদিকে তার রাজনৈতিক অবস্থান ও প্রবণতা তাকে একটি বিচিত্র গ্রহণ-বর্জনে রেখেছিল, রেখেছে এখনো। তবে, সন্দেহ নাই, তার কাব্যকীর্তিই নাক্ষত্রিক দ্যুতি ছড়িয়ে বহাল থাকবে।

আমার ইচ্ছা করে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তার সমাধির পাশে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে আসি।

এ সম্পর্কিত আরও খবর