সভ্যতার ইতিহাস নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। যে সভ্যতা নিয়ে গৌরব করে পশ্চিমা দুনিয়া, তার বুনিয়াদের মধ্যে লুকিয়ে আছে দখল, লুণ্ঠন, নির্যাতন ও রক্তপাতের ইতিবৃত্ত। প্রতিটি নির্মাণ, উল্লাস ও উৎযাপনের পেছনে চাপা পড়ে আছে গোপন অশ্রুপাত। ফলে সভ্যতার ইতিহাস নামক মুদ্রাটির একপাশে যা রয়েছে, উল্টা পাশে রয়েছে ঠিক বিপরীত চিত্র।
এই সভ্যতার ইতিহাস নিয়ে তীব্র বিতর্কের মতোই বিদ্যমান রয়েছে প্রচণ্ড ভিন্নমতও। পশ্চিমা-ইতিহাস বয়ানকে মানে না পূর্বদেশের পণ্ডিতরা। ক্যাপিটালিস্ট ইতিহাসকে অস্বীকার করে মার্ক্সীয় ব্যাখ্যা। ইসলাম সভ্যতার ইতিহাসকে দেখে এদের চেয়ে আলাদা দৃষ্টিকোণে। এসব কারণে, কারো কাছে যা সভ্যতা, আরেক পক্ষের কাছে তা অন্ধকার। যেমন, ইউরোপের কাছে মধ্যযুগ অন্ধকার। কোন মধ্যযুগ? চতুর্থ থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর ইউরোপের সময়কাল। যখন গির্জা মানুষকে দাসে পরিণত করেছিল। ধর্মের নামে পুড়িয়ে মারছিল। ঠিক একই সময়কালে, ভারতে, আরবে, চীনে ও বিশ্বের অন্য কিছু স্থানে শিল্প, সাহিত্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি, স্থাপত্য ও নির্মাণের সমৃদ্ধি ছিল অতুলনীয়। একইভাবে, ইউরোপের উৎকর্ষের পেছনে রয়েছে ঔপনিবেশিক লুটতরাজ, লাতিন আমেরিকার আদিবাসী ও আদি-সভ্যতাকে ধ্বংস করার বর্বরতা।
অতএব, সভ্যতা বললেই হয় না, তা কতটুকু সভ্য, মানবিক ও কল্যাণকর, সেটাও বিবেচ্য। এসব বিশ্লেষণ করে সভ্যতার গতি-প্রকৃতি তুলে ধরার প্রয়াস কম নয়। তবে সেগুলো কোনো একটি পক্ষ বা মতের প্রতিনিধিত্বকারী। সামগ্রিকভাবে সভ্যতার প্রতিটি অভিমুখকে ধরে ধরে আলোচনা ও বিশ্লেষণ করার চেষ্টা খুবই কম। বাংলা ভাষায় অত্যল্প।
‘পৃথিবীটা কীভাবে জলদস্যুদের হলো‘ নামের গবেষণা গ্রন্থটি সভ্যতার ইতিহাসের এক প্রাঞ্জল বিবরণ। তবে তা কেবল বিবরণই নয়, বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নও বটে। গভীর সমীক্ষায় পৃথিবীর ইতিহাসের নানা পর্যায় ও সভ্যতার নানা পর্ব তুলে ধরা হয়েছে বইটিতে। ঘটনার প্রকৃত চিত্রের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে নেপথ্যের গুপ্ত-কার্যকারণ। ফলে সভ্যতার ইতিহাসের প্রতিটি উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার একটি বহুমাত্রিক ব্যাখ্যা পাওয়া সম্ভব হয়েছে। যাদেরকে মহান অভিযাত্রী বলা হয়, তারা যে ছিল লুটেরা জলদস্যু ও দাস-ব্যবসায়ী, সেটাও উদ্ভাসিত হয়েছে। বিভিন্ন জাতিগত হত্যা ও নিধনের অসংখ্য ঘটনার পাশাপাশি ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিলুপ্তিকরণের উপাখ্যানও বের হয়ে এসেছে। সভ্যতার আলো ও অন্ধকারের এমন পরিচ্ছন্ন ও তথ্যনিষ্ঠ বর্ণনা সত্যিই দুর্লভ।
অবাক করা বিষয় হলো, প্রায় ৪০০ পৃষ্ঠার বিপুলায়তন বইটি দীর্ঘদিন গবেষণার মাধ্যমে রচনা করেছেন মফস্বলের এক তরুণ অধ্যাপক। ছয়টি অধ্যায়ে বিন্যস্থ গ্রন্থটি সভ্যতার ইতিহাসের প্রথম খণ্ড। যার আরো খণ্ডগুলো নিয়ে কাজ করছেন লেখক। প্রচুর দেশি-বিদেশি তথ্য, উপাত্ত ও আকর গ্রন্থ বিশ্লেষণ করে তিনি সভ্যতার ইতিহাসকে পুনঃমূল্যায়ন করার যে প্রচেষ্টা নিয়েছেন, তা সাহসী ও বুদ্ধিদীপ্ত।
‘পৃথিবীটা কীভাবে জলদস্যুদের হলো‘ নামের গবেষণা গ্রন্থটির লেখক মুহাম্মদ ফজলুল হক দাউদ, তার জন্ম ১৯৮৩ সালে ফেনী জেলার ফুলগাজী উপজেলায়। তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স, ইংরেজী ভাষা ও সাহিত্যে মাস্টার্স এবং এল এল বি ডিগ্রি অর্জন করেন। বর্তমানে মফস্বলে স্নাতক পর্যায়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন। লেখকের প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে রয়েছে: গল্পগ্রন্থ 'জীর্ণপাতা', রম্য গল্পের বই 'রঙ্গ ব্যঙ্গ', রম্য গল্পের বই 'গা ঘেঁষিয়া দাঁড়াইবেন না'। প্রকাশের পথে আছে: কিশোর উপন্যাস 'জোড়া পাহাড়ের গহীন অরণ্যে', অণুগল্পের বই অল্প কথার গল্প'। লেখক ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের ইতিহাস নিয়ে লিখিত বই 'পৃথিবীটা কীভাবে জলদস্যুদের হলো' এর দ্বিতীয় খণ্ড নিয়ে বর্তমানে কাজ করছেন। তাছাড়া বাংলার নবাবী আমল ও ভারতের মুঘল সাম্রাজ্যের শেষ অধ্যায়ের ইতিহাস নিয়ে লিখিত 'গল্প আড্ডায় নবাবী বাংলা ও মুঘল সন্ধ্যা' এবং নবাব সিরাজ উদ্দৌলার জীবনভিত্তিক ইতিহাস নির্ভর উপন্যাস 'খোশবাগ' রচনাতেও তিনি ব্যস্ত রয়েছেন।
ইতিহাসচর্চা প্রকৃত প্রস্তাবে গভীর পরিশ্রম ও তথ্যনিষ্ঠার মাধ্যমে আত্মজিজ্ঞাসার মুখোমুখি হওয়ার নামান্তর। প্রযুক্তি ও বাণিজ্য প্রভাবিত পরিস্থিতিতে ইতিহাসের কঠিন ও কণ্টকাকীর্ণ পথে অগ্রসর হয়ে সত্যের মুখচ্ছবি উদ্ভাসিত করার মেধা যেমন অনেকের থাকেনা, তেমনি এমন অলাভজনক কাজে মনোনিবেশ করার মানসিকতাও অনেকের হয় না। যখন অধিকাংশই সম্তা লাভ ও লোভের বশবর্তী হয়ে চট-জলদি কিছু হাতিয়ে নিতে আগ্রহী, তখন ইতিহাসের দুর্গম পথ পাড়ি দেওয়ার উচ্চাভিলাসী প্রকল্প নিয়ে কাজ করার হিম্মত দেখিয়েছেন লেখক-গবেষক মুহাম্মদ ফজলুল হক দাউদ। তার এই মহতী প্রচেষ্টা সাধুবাদের যোগ্য।