আধুনিক বাংলা সাহিত্যের বিশাল জগতের সিংহভাগ জুড়ে রয়েছে কাব্যাঙ্গন। কাব্যাঙ্গনের বৃহদায়তনে এক নিভৃতচারী কবির নাম মিলটন সফি। কব্যভাব যাকে আবিষ্ট করে, আঁকড়ে ধরে, আকণ্ঠ ভাবজগতে নিমগ্ন করে, ভাব সমুদ্রের গভীরে তলিয়ে তাড়িয়ে বেড়ালে রূপায়িত হয় কবিতা। ভাবকে তিনি আমন্ত্রণ জানান না। কবিতা ধরা দিলেই তিনি লিখেন। এটি তার তৃতীয কাব্যগ্রন্থ। প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ হয় ২০০৪ সালে। দ্বিতীয়টি পরের বছর। এরপর দীর্ঘ ১৫ বছর কবি হিসেবে কাব্যজগতের সূর্য কিংবা চন্দ্রলোকে দেখা নেই তার।
কবির ভাষায় " একটা সময় ছিলো যখন এক দুপুরে দশ-বারটা কবিতা লিখে ফেলতে পারতাম। এখন তা পারিনা। কবিতা আমাকে নির্বাসন দিয়েছে, তাই নিভৃতে নির্বাসনে কেটে যায় সময় অসময়। জীবন ও জীবিকার অর্থ -অনর্থ দাঁড় করাতে না করাতেই চলে যায় দিন-মাস-বছর, বড় অবহেলায়।
সুতরাং কেন তিনি নিভৃতে নির্বাসনে ছিলেন এ প্রশ্নের জবাব দেয়ার চেষ্টা কিংবা কারণ বিবৃত করার বাসনা পরিত্যাগ করাই সমীচীন হবে বলে মনে করি। কিংবা এর মীমাংসার দায়িত্ব পাঠকের জন্যেই থাকুক।
মূলতঃ প্রচার বিমুখ এই কবি মানুষ হিসেবে, মানবিক গুণাবলীতেও অনন্য সাধারণ। পেশায় ব্যাংকার মিলটন সফির রয়েছে এক বড় গণযোগাযোগ জগৎ। সেবায় যেন তিনি সকলের। ভাবেন অনেক, বলেন খুব কম। সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের পৃষ্ঠপোষকতায় সমসাময়িক কালে, সমগোত্রীয়দের মধ্যে তার জুড়ি নেই বলে আমার বিশ্বাস। কাব্যকলায় তার পাণ্ডিত্যের বিস্ফোরণ "নিভৃতে নির্বাসনে" উচ্চকিত। বিশেষ করে প্রেমের কবিতায় প্রকৃতিই তার অন্যতম প্রধান উপজীব্য বিষয়।
মিলটন সফির কবিতার প্রতিটি লাইনেই যেন বিন্দুর মধ্যে সিন্ধুর গভীরতা লক্ষণীয়। যা বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছোট গল্পকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে বলেছিলেন। কবিতার ছোট্ট পরিসরের উদরে তার তুলনায় বিশালকায় ছোট গল্পের ভাববৈচিত্র্য সন্নিবেশিত করার মত আরও দুর্বোধ্য এবং দুর্গম পথে দুর্বার যাত্রায় তার অদম্য গতির সুস্পষ্ট সাক্ষ্য আলোচ্য ‘নিভৃতে নির্বাসনে’।
বইটিতে সন্নিবেশিত কবিতাগুলো পাঠ করে প্রতিটি পাঠকেরই মনে হবে এর প্রায় প্রতিটি কবিতায়, প্রতিটি ছত্রে যেন তিনি এঁকেছেন সৌন্দর্যের এক একটি লীলাভূমি। আধুনিক বৈজ্ঞানিক সভ্যতার যুগে, মহাজাগতিক কাল-পরিক্রমায়, দিব্য দৃষ্টিতে অবলোকন করলে মনে হতেও পারে মিলটন সফির প্রতিটি কবিতায় প্রতিটি লাইনেই যেন এক একটি কাব্য পরমাণু।
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের কাব্যাঙ্গনে নব্বইয়ের দশকে আবির্ভৃত হন কবি মিলটন সফি। কাব্যচর্চায় সিদ্ধহস্ত মিলটন সফি শুধু কবিই নন, বাংলা সাহিত্যের প্রায় সকল বিভাগেই তার রয়েছে কম-বেশী বিচরণ। লেখক হিসেবে সার্থকতাও রয়েছে সব ক্ষেত্রেই।
২০০৪ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম কাব্যগ্র্রন্থ "কালোপুরুষ" দ্বিতীয় কাব্যগ্র্রন্থ "একটি স্বপ্নস্নাত নারীর জন্যে প্রার্থনা" প্রকাশিত হয় পরের বছরই। তারপর পনেরটি বছর স্বেচ্ছায় নির্বাসনে থাকার পর ২০২০ সালে আবার সগৌরবে, স্বমহিমায় আত্মপ্রকাশ। প্রকাশিত হয় ‘নিভৃতে নির্বাসনে’ বাংলার কাব্যাকাশে বিস্ফোরিত হয় এক কাব্য পরমাণু। ধুয়াকু-লীতে আচ্ছাদিত হয় চারদিক। কাব্যাকাশের সব উজ্জ্বল নক্ষত্র যেন আচ্ছাদিত হয় ধোয়ায়। দূরে-বহুদূরে, খালি চোখে আর দেখা নেই কারো। ক্ষাণিক পর ঠিক তার মধ্যভাগে, মিটমিট করে দৃষ্টি কাড়ে একটি নক্ষত্র, ক্রমেই ধুয়াকু-লী ভেদ করে অণুবিক্ষনে যেন জ্যোতি ছড়াতে থাকে, উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর দীপ্তিমান হয়ে উঠে উর্ধ্বাকাশের মধ্যভাগে লাল নীলে ‘নিভৃতে নির্বাসনে’
নিম্নে তার মিলটন সফি, যেন আরেক মহীরুহ'র আবির্ভাব। এটি তার তৃতীয কাব্যগ্রন্থ। এই গ্রন্থের সূচিতে তিনি সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন ৬৬ টি কবিতা। রয়েছে একটি মুখবন্ধ, উৎসর্গ এবং শেষে সংক্ষিপ্ত কবি পরিচিতি।
প্রেম, প্রকৃতি, নারী, শ্রেণীসংগ্রাম, সমাজবাস্তবতাসহ নানাবিধ বিষয় তার কবিতার উপজীব্য হলেও আলোচ্যে গ্রন্থের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কবিতায় প্রেমের সুর অনুরণিত।
হৃদয়ে প্রেম থাকলে দৃষ্টিতে তা বিচ্ছুরিত হয়, কোনো সৌন্দর্যই দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে পারে না। একজন কবি যখন কাব্যভাবসমুদ্রে নিমগ্ন থাকেন, তখন তার নির্জলা প্রেমের দৃষ্টি অপরূপ সৌন্দর্যম-িত হয়ে উঠে। তখন তিনি যা অবলোকন করেন, তার প্রকৃত রূপ বর্ণনায় নিখুঁত পারদর্শী হয়ে উঠেন। খুঁজে পান স্রষ্টার সৃষ্টির প্রকৃত রূপ। এ প্রসঙ্গে কবির "পৃথিবীতে খুব বেশী নেই আর" এর কটি লাইন তুলে ধরা হলো -
‘আমি চোখ নামিয়ে ওর চোখের জলে
কদমের ছায়া দেখলাম এবং
সেদিনই প্রথম বুঝেছিলাম -
মানুষের মুখের চেয়ে সুন্দর ফুল
পৃথিবীতে খুব বেশী নেই আর,।
এই যে চোখ নামিয়েই ওর চোখের জলে কদমের ছায়া দেখা এবং তা থেকে বুঝতে পারা, মানুষের মুখের চেয়ে সুন্দর ফুল পৃথিবীতে নেই আর। অর্থাৎ ছোট্ট একটি শিশুর মুখকে
সুন্দর পৃথিবীতে এতসব প্রজাতির সুন্দর সুন্দর ফুল থাকতেও কবি বর্ষা ঋতুতে প্রস্ফুটিত কদমকে সবচেয়ে সুন্দর ভেবে কল্পলোকে এক শিশুর মুখে তা বসিয়ে দিয়ে শিশুর মুখকেই সবচেয়ে সুন্দর ফুল হিসেবে আবিষ্কার করেছেন।
একথা মহাসত্য, ঐশীগ্র্রন্থ মহাপবিত্র আল কুরআনে সৃষ্টির সেরা এবং সর্বশ্রেষ্ঠ হিসেবে স্বীকৃত মানবজাতিকে নি:সন্দেহে সবচেয়ে সুন্দর করে সৃষ্টি করেছেন মহান স্রষ্টা, আবার তার মধ্যে সেরাটাও মানুষের মুখ। কবি এখানে যথার্থই সুন্দরের সুন্দর উপমা হিসেবে এনে নিজের সৃষ্টি জগতের প্রতি প্রেম ও সৌন্দর্য প্রীতির সার্থক স্বাক্ষর রেখেছেন।
আবার একই কবিতার প্রথম স্তবকে তিনি লিখেছেন -
"বর্ষাই আমার প্রিয় ঋতু
তবু বর্ষাতেই বড় আনাড়ি হয় মন
যদি ধরে নিই, আকাশের একটা মন আছে
তবে নিশ্চিত, তার মনের সাথে
আমার মনের কোথায় যেন মিল আছে।
অর্থাৎ বাংলার ষড়ঋতুর মধ্যে বর্ষা, কবি, সাধক, ভাবুকদের কাছে যুগ যুগান্তরের আবেগের, সৌন্দর্যের চিরন্তন অনুভূতির সমুজ্জ্বল স্বাক্ষরবাহী এক মহীরুহ। এখানেও কবির আবেগাপ্লুত মন ও ভাবালুতার যথার্থই সার্থক রূপ ফুটে উঠেছে।
"সেই জামগাছটা নেই" কবিতার মধ্যভাগে তিনি লিখেছেন -
'পরদিন সকালে উঠে তুমি পেলে
একরাশ ঝরাফুল, আমাকে ভুলোনা বলে
ফুলগুলো নিঃশব্দে রেখে এসেছি
তোমার দরজায়, তোমার পায়ের
স্পর্শে যে ফুল পেল সজ্জা
সেটাও কিছু কম ছিলনা সেই সময়
অথবা-
'কোথাও বৃষ্টি ঝরছে’ কবিতায়
"মনে পড়লো তোমাকে বিদায় জানিয়ে এসে
প্রচ- বৃষ্টিতে পেয়েছিল সেদিন
মনে হয়েছিল তুমি বৃষ্টি হয়ে এলে
আমার ধুসরতা ধুয়ে নিতে
আমি পরিপূর্ণভাবে নিজেকে সমর্পণ
করলাম তোমার কাছে”।
বাঞ্ছিতকে মনে করে নিরবে, নিভৃতে, নিঃশব্দে, চুপিসারে দরজায় একরাশ ফুল রেখে আসা, যেন অলক্ষ্যে তার পদপিষ্টে হলেও স্পর্শ পায় ফুল, পায় সজ্জা। আর এই পাওয়ার মধ্যে কবি পরম পাওয়ার তৃপ্তি লাভ করতেন, যা এক সময় সেই জামগাছটার জন্যে পেতে চাইলেও পেতেন না। তাই তিনি শেষাংশে লিখেছেন -
'তোমাদের জামগাছটা কেটে ফেলেছো
শুনেছি, ঐ গাছটার জন্যে
কখনও তোমাকে প্রাণ ভরে দেখতে পেতাম না',
কবি মনের এই যে অভিব্যক্তি, কাক্স্খিতকে না পাওয়ার বেদনার আর্তি, আর পাওয়ার চেষ্টায় গোপনে রেখে যাওয়া তার ফুলে অজ্ঞাতে চরণ স্পর্শটুকু নিয়ে ভাবনায়ও যেন প্রশান্তি।
এই ভাবনা এবং এমন ভাবনা কোন সাধারণের নয়। বরং অসাধারণেরই হয়। তাইতো তিনি কবি। এখানেই নিহিত কবিত্ব শক্তি।
ঠিক এরই সম্পূরক কবিতা কবির ' কোথাও বৃষ্টি ঝরছে '
সেখানে তিনি এক ঐকান্তিক অনুভূতিতে শিহরিত হয়েছেন প্রচন্ড বৃষ্টিতে। বলে উঠেছেন তোমার কাছে নিজেকে পরিপূর্ণভাবে সমর্পণ করলাম। প্রিয়জনকে দূরে কিংবা কাছে বিদায় জানিয়ে সেই বিরহে যখন কাতর, তখনই প্রচন্ড বৃষ্টি পেয়েছে তাকে, এই বৃষ্টি প্রাকৃতিক ধারায় উর্ধ্বলোক থেকে পতিত কিংবা বিরহ কাতরতায় মনোজগতে বয়ে যাওয়া ঝড়ের তীব্রতায় অজান্তে দৃষ্টিতে ঝরা জল, যাকে তিনি ভেবে নিয়েছেন, তার প্রিয় ছেড়ে যায়নি দূরে কোথাও....
ফিরে এসেছে বৃষ্টি হয়ে তার মনের ধূসরতা ধুয়ে নিতে, অমনি তিনি তাতে সমর্পিত সম্পুর্ণভাবে।
এখানেই তিনি ব্যতিক্রম। তিনি যা দেখেন, তার গভীরে প্রবেশ করে তলদেশে অরক্ষিত মুক্তা সংগ্রহ করে উপলব্ধিতে বসান। তারপর তার নির্যাসটুকু অনুভূতিতে মিশিয়ে, চর্বিত-চর্বন করে, ভক্ষণ করে নির্যাসটুকু ঘটান কাব্যে, পাপ কিংবা পূণ্যে, প্রেম কিংবা দ্রোহে, মিলন কিংবা বিরহে, ফুল কিংবা কাটায়, মিষ্ট কিংবা কটুতায়, আবেগ কিংবা ভাবাবেগে পরিপূর্ণ করে। আঁধারের গভীরে প্রবেশ করে আলোক বর্তিকা আবিষ্কারে পারদর্শী, কঠিনতম কটুতায়ও পরম সুখের সন্ধান দেন, কন্টকাকীর্ণ পথে যোজন-যোজন দূরে মনৃণ পথের আবিষ্কারক, চরম তিক্ততা ভেদ করে পরম প্রেমের পরাগ, পূতিদুর্গন্ধময় নর্দমায় সুভাসিত ফুলের সুবাস আর প্রিয়জনের পদপিষ্ট হয়েও তার স্পর্শে ভালোবাসার অতৃপ্ত বাসনার পরিপূর্ণ তৃপ্তি লাভে পুলকিত হন। উল্লিখিত কবিতা দুটির উদ্ধৃত লাইন কটিতে তা সুস্পষ্টরূপে বিবৃত করতে যথার্থই পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। এখানে তিনি পুরোপুরিই ‘রিয়ালিস্ট’। এই রিয়ালিজমই নি:সন্দেহে একজন সার্থক কবি হিসেবে মিলটন সফিকে তার যথার্থ স্থানে বসিয়ে দিয়েছে।
এরপর "যে ফুলে মিলনের গন্ধ" কবিতার শেষ স্তবকে তিনি লিখেছেন -
"ঐ লম্বা দূরে, ঐতো ঐখানে
ডুবেছে আমার মিলনের তরী
নদী পথে পথ নেই জেনেও
তাকে আমি সমধিক ভালোবাসি।
যে নদীতে জল নেই, অন্তসার শূন্য
তার কষ্টকে আজ আমি
সমধিক উপলব্ধি করি"।
অর্থাৎ ভালোবাসা অমর, অক্ষয়, মরেনা কখনো। যদি তা প্রকৃত ভালোবাসা হয়। তাই কবি বলেছেন, যে নদীতে একদিন জল ছিল, ছিল জোয়ার, ঐ দূরে যেখানে তার মিলনের তরী নিমজ্জিত হয়েছে একদিন ভালোবাসায় পরিপূর্ণ হয়ে। আজ সে নদীতে জল নেই, জোয়ারও নেই, শুধু ধূ-ধূ বালুচর, অন্তসার শূন্য। তারই কষ্ট আজ তাকে সবচেয়ে বেশি কষ্ট দেয়, তাকেই তিনি সমধিক ভালোবাসেন আজও। যে ফুলে মিলনের গন্ধ ছিল, কিন্তু আজ আর নেই, তাকেও তিনি ভালোবাসেন।
"বৃষ্টির কাছে পরাজিত আমি "কবিতার প্রথম স্তবকে তিনি বলেছেন -
"আকাশটা বেশ মেঘলা
বৃষ্টি হবে হবে মনে হচ্ছে
তব্ওু যেতে হবে যে করেই হোক
কেননা আজ তুমি আসছো”।
মেঘলা আকাশ, মনে হচ্ছে বৃষ্টি আসবে, তবুও যেতে হবে গন্তব্যে, যেখানে তার প্রিয় কেউ আসছে আজ। সুতরাং কোনো বাধাই তাকে আটকে রাখতে পারে না।
আবার একই কবিতার শেষের দিকে বলেছেন,
"যে বৃষ্টি আসবে আসবে করেও
এলো না, তার জন্যেই ছিল প্রতিক্ষা
আর যে এসেও ফিরে গেলো
তার জন্যে ছিল না কোনই অপেক্ষা”।
এই যে অপেক্ষা এর কোন শেষ নেই। ভালোবেসে মানুষ অপেক্ষা করে তার প্রিয়জনের জন্যে। এই যে ভালোবাসা এটা নিখাদ, প্রতিটি মানুষের ক্ষেত্রে তাই হয়। যদি তা একমুখী হয়, তাহলেও তা ভালোবাসাই হয়। তাতে হয়তো মিলনের সুখ থাকে না, বিরহের যন্ত্রণা থাকে এক পক্ষের, তবুও ভালোবাসা মিথ্যে হয়ে যায় না, উপরোক্ত চারটি লাইনের অন্তর্নিহিত ভাব বিশ্লেষণে একথাই সুস্পষ্ট হয়ে উঠে। এরপর "তোমায় ভালোবেসে" কবিতার প্রথম ও শেষ পাঁচ চরণ-
"যতটুকু বৃষ্টি পড়ে
সমস্তটুকুই আমার শরীর
দৃশ্য - দৃশ্যান্তরে চোখ বন্ধ করে
পায়ে পা ফেলে সারিবদ্ধভাবে
এগিয়ে যায় অকারণ, তোমায় ভালোবেসে"।
ভালোবাসা কোনো কারণ কিংবা বারণ মানে না। এর উৎপত্তি এবং পরিনতি কখন, কোথায়, কিভাবে, কেউ তার নিশ্চিত কেন্দ্র নির্ণয় করতে সক্ষম হয়েছে, হচ্ছে, কিংবা হতে পারবে এমনটা কে বলতে পারে। কারণ প্রেম পবিত্র এবং স্বর্গীয় সুখের অনুভূতির নাম। কিভাবে বড় হয়, কোথায় এর শেষ, কি পরিনতি, কেউ তা আগে থেকে জানে না। তা উপলব্ধি করেই কবি বলেছেন "এগিয়ে যায় অকারণ, তোমায় ভালোবেসে"। শেষটায় ওই কথাই আসে, যেখান থেকে আসে প্রেম সেখানেই মিলিয়ে যায়। কবি মিলটন সফির কবিতার সাথে কিংবা তার সাথে কবিতার প্রেম সেই অলঙ্ঘনীয় সত্যের সাক্ষ্য। প্রেমের কবি হিসেবে তিনি এখানে পুরোপুরি সার্থক।
এরপর ‘পথেই বসে আছি’ কবিতায়
‘ধুপখোলায় পুড়তে দিয়েছি হৃদয়
লাল না হওয়া পর্যন্ত তা জ্বলতেই থাক’।
অথবা- ‘নিম ফুলের মতো ভালোবাসি’ কবিতায়
‘ভুলিনি আমার ভালোবাসায় তোমার নীরবতা
তোমার বঞ্চিত মুখ আমার অযোগ্যতা
জেনে গেছি আজ, তোমাকে ঠেকানোর চেয়ে
নিজেকে বঞ্চিত করা সহজ’।
ভালোবাসা এবং ত্যাগের মহিমায় বড় প্রেমের ঐশ্বর্য্যরে নির্জলা চিত্র এঁকেছেন। এখানে তিনি কাব্যভাবের গভীরতার মধ্যদিয়ে সেই অমিয় বাণীর অবতারণা করেছেন। "বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না, কখনো কখনো দূরেও ঠেলে"। তিনি ছোট ছোট চরণে বিন্দুর মধ্যে সিন্ধুর গভীরতা এনে কবিতার এক একটি লাইনকে পরমাণু শক্তিতে পরিনত করেছেন, জ্ঞাতসারে কিংবা ভাব জগতে নিমজ্জিত হয়ে অজ্ঞাতে কবিতাগুলো হয়ে উঠেছে তার আধুনিক কবিত্ব শক্তির জোরে অত্যাধুনিক কাব্য পরমাণু।
এরপর তবু আমি ফিরবোই, ফাগুনের চিঠি, হৃদয় ভাঙ্গার গল্প, প্রার্থনায় নিমগ্ন আছি, সেদিনের জন্যেও অপেক্ষায় থাকবো, থেকে যায়, থেকে যেতে হয়, বোঝ বলেই বোঝ না, কেউ কি ভালোবেসেছে, পত্র দিও, কবে দেখবো তোমায়, আজও সকাল হলো না, ইত্যাদি কবিতাগুলোর অন্তর্নিহিত ভাব কিংবা প্রতিটি চরণই প্রেমের কষ্টিপাথরের ছোঁয়ায় একেকটি প্রেম পরমাণুতে পরিনত হয়ে উঠেছে। তাই একজন সমালোচক তাকে বিশ্বখ্যাত রোমান্টিক কবি মিলটনের সাথে তুলনা করেছেন। আমি বলবো সেকালের মিলটনের চেয়ে একালের মিলটন সফির কবিতা প্রেমের কষ্টিপাথরে বিচারে অনেক বেশি শক্তির আধার। প্রেমের পরাগরেনু কিংবা কাব্য পরমাণু সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে, কিংবা বড় প্রেমের ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত বেদনা কিংবা পরম সুখের পংক্তিমালা গাঁথায়, কাছে টানা অথবা দূরে ঠেলার অমর কাব্যবাণ নিক্ষেপের সুদক্ষ কারিগর হিসেবে কাব্যাকাশের বিশাল অঙ্গন জুড়ে রথী মহারথীদের সুবিন্যস্ত, সুরক্ষিত আসন সমূহের মধ্যভাগে ঝড়োগতিতে আবির্ভূত হয়ে স্বীয় আসনটিতে স্বমহিমায় আসীন হয়ে কাব্যাকাশের জ্যোতি বিকিরণের গতিতে সমৃদ্ধি আনয়নের মধ্যদিয়ে নিজের অনন্যসাধারণ কবি প্রতিভার সুউচ্চ মার্গ প্রদর্শনে সক্ষম হয়েছেন। এখানে তার তুলনা তিনি নিজেই।
উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে একথা নিশ্চিত করে বলতে পারি।
মিলটন সফিকে মূলত প্রেমের কবি হিসেবে ধরে নিলেও, কিংবা প্রেম বিষয়ে তার কাব্যপিপাসা, ভাবগাম্ভীর্যের সাথে তার কাব্যভাবনার প্রকাশ এবং পংক্তিতে পংক্তিতে তার বিচ্ছুরণ তাকে প্রেমের কবি হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠা দিলেও তিনি শুধুমাত্র এখানেই থেমে থাকেননি। তার কাব্যপ্রতিভা বহুমুখী ধারায় প্রবাহিত হয়েছে সতর্কতার সাথে। এমন বহু কবিতার তিনি রচয়িতা, যেগুলো পাঠে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় সমাজের হেন কোনো বিষয় নেই, যা তার দৃষ্টিকে এড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে, কিংবা এড়িয়ে গেছে। সমাজবাস্তবতার সব দিক নিয়ে তিনি লিখেছেন
বহু কবিতা, যা আমাদের এই সমাজেরই জলজ্যান্ত প্রতিচ্ছবি। এমন একটি কবিতা "বেঁচে থাকা ভালো" যার শেষাংশের দুটি স্তবক তুলে ধরলেই পাঠকমাত্রেরই ধারণা সুস্পষ্ট হতে পারে।
"হায়রে সংসার, কোথায় গেলো
আবুলের মায়
নোলক দুলিয়ে দুলিয়ে
যে কথা বলতো, বার বছর
বয়সে যে এসেছিলো ঘরে
সে আজ পথেই সংসার পেতেছে
বিধাতার বিচার আছে, এক টুকরো জমির
বদলে পুরো জমিদারী
পুরো আকাশটা তার ঘরের ছাদ
আহা: বিধাতার বিচার আছে”।
এখানে কবি সুনিপুণভাবে এঁকেছেন আমাদের এই সমাজের চারপাশের বাস্তব চিত্র। যা আশপাশে তাকালেই দেখা যায়, বোঝা যায়। সমাজবাস্তবতা বা শ্রেণী বৈষম্যের প্রতিবিম্ব এতে সুস্পষ্ট। যে আবুলের মায় বার বছর বয়সে এসে ঘর বেধেছিল, সংসার পেতেছিল সুখের আশায়। শ্রেণীবৈষম্য আর সমাজপতিদের শোষণের শিকার আবুলের মা আজ পথেই পেতেছে সংসার।
যে একদিন এক টুকরো জমি আর ছোট্ট একটি ছাদ চেয়ে নোলক দুলিয়ে দুলিয়ে কথা বলতো, তার ঘর আজ ফুটপাতে, খোলা আকাশের নীচে। যেন পুরো জমিদারীই তার। পুরো আকাশটাই তার ঘরের ছাদ। এই যে সর্বহারা মানুষের পাওয়া-না পাওয়ার, আশা-নিরাশার মাঝেও আশা জাগানিয়া শান্তনার বাণী কবিকণ্ঠে উচ্চারিত, এটা কেবল বড় কবির দৃষ্টিতেই দেখা সম্ভব। যিনি দুনিয়ার পুরো জমিদারীটাকেই এক জমিদারী হিসেবে দেখেন, তার দৃষ্টিতে যার প্রকৃত মালিক আবুলের মায়েরা।
“সূতোকাটা ঘুড়ি" কবিতায় লুকিয়ে আছে সৃষ্টি রহস্য। যা ভেদ করার সাধ্য কারো নেই, কবি কিংবা নবী। এখানে সবাই অসহায়, যে যেই পথেই আসুক সাধনায়, এক মোহনায় প্রচ- ঘূর্ণিপাকে এসে সবাই হারিয়ে যায় অদৃশ্য সুতোর টানে, আবার ফেরে সেই স্থানে। গোলাকার পৃথিবীতে। কবির ভাষায় -
"অমনি নিজেকে সুতোকাটা ঘুড়ি ভেবে
ভাসিয়ে দিয়েছি বাতাসের প্রবাহমানতায়, যখন -
খোলা মাঠের চৈতালী বাতাস আমাকে ডেকেছে
নীমফুল আর সোনালী স্বপ্ন মাতিয়েছে সারাবেলা
যখন নিজেকে পেয়েছি পরিপূর্ণ মুগ্ধতায়
তখনই কেউ নাটাইয়ের সুতো টানছে
তবে কি অদৃশ্য ঐ প্রান্তে কেউ একজন
রয়ে গেছে হায়!
তোমার প্রয়োজনের কাছে
নিতান্ত ক্ষুদ্র এ অভিপ্রায়"।
এই যে রহস্যাবৃত্ত সৃষ্টি, চলছেতো চলছেই, আবার থমকে দাঁডাচ্ছে, শুরু থেকে শেষ এবং শেষের শেষটা থাকছে অজানা, এক অজানা বিশ্বাস। এই সীমারেখাই সৃষ্টি রহস্য বলে আমারও বিশ্বাস। এই বিশ্বাসের বৃত্তে ঘুর্ণায়মান থেকে এতটুকু সময়ে যত সৃষ্টি দৃষ্টির সামনে কিংবা অন্তরালে, সেখানে কীর্তিমান কবি মিলটন সফি তার বিচিত্র সৃষ্টিতে।
সার্থক কবি মিলটন সফি। তার কবিতার বিষয়বস্তু নির্বাচনেও রয়েছে বৈচিত্র্য। তিনি একাধারে প্রেম, ভালোবাসার কবি। পরিবেশ-প্রতিবেশ, জীবন-প্রকৃতি, অতিপ্রাকৃত, সমাজবাস্তবতা, শ্রেণিবৈষম্য, সামাজিক মূল্যবোধ, নৈতিক দর্শন ইত্যাদি বিষয়ে লিখেছেন।
তবে তার সগৌরবে আবির্ভাব রোমান্টিক কবি হিসেবে।
দেশের সুপ্রতিষ্ঠিত দৈনিক থেকে শুরু করে, সাপ্তাহিক, মাসিক, পাক্ষিক এবং সাহিত্য সাময়িকীতে তার বিচিত্রমুখী লেখা ছাপা হচ্ছে। তিনি কবিতা লেখার স্বপ্ন দেখেন না, তবে কবিতা তাকে যখন স্বপ্ন দেখায়, তখন তিনি তা রচনার মাধ্যমে মানুষকে স্বপ্ন দেখান। আবৃত্তি এবং গান রচনার মাধ্যমে মানুষকে তিনি সচেতন করেন, আলোকিত করেন। তিনি শুধু আবৃত্তি নয়, নির্দেশনা এবং গ্রন্থনাও করে থাকেন। তিনি সাহিত্যকর্মে বিশেষ সম্মাননা হিসেবে ২০১৮ সালে "পার্সন অব দ্য ইয়ার" এ্যাওয়ার্ড অর্জন করেন।
ফরিদপুরের নগরকান্দা থানার কোদালিয়া গ্রামের ঐতিহ্যবাহী মুসলিম পরিবারে ১৯৮১ সালের ১১ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন কবি মিলটন সফি। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের কাব্যাঙ্গনে বিরল প্রতিভার অধিকারী এই কবি, গীতিকার, বাচিকশিল্পী ব্যবসা প্রশাসনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। কর্মজীবন শুরু করেন স্ক্রিপ্ট রাইটার হিসেবে। তারপর দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় বর্তমানে একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্র্যান্ড এন্ড কমিউনিকেশন বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
আলোচ্য গ্রন্থের শেষের দিকের দুটো কবিতার আগে রয়েছে শিরোনামের কবিতা "নিভৃতে নির্বাসনে" যার প্রথম দুটি স্তবকে লিখেছেন -
"চোখের জলে গল্প লিখি তোমার
নিজেকে ক্রুশবিদ্ধ করার
সমস্ত আয়োজন শেষ
নিজের পায়ে নিজেই ঠুকেছি
বিশ্বস্ত পেরেক, যেন তোমার থেকে পালিয়ে না যাই।
আগাম ভোরের বিশ্বস্ত আয়োজনে
তুমি কিন্তু এসো!
তোমাকে ঘিরেই এ আয়োজন
তোমাকে কাঁদাবো বলেই হয়ত
আজ এ সুখের নির্বাসন”।
কেন কবি নির্বাসনে গেলেন, দীর্ঘ ১৫ টি বছর পর কাব্যাঙ্গনে আবার কেন, কিভাবে, কি কারণে ফিরে এলেন তা খুঁজে নিতে হবে পাঠককেই, তার এই গ্রন্থের প্রচ্ছদের প্রথম ভাজের ভূমিকা কিংবা ভেতরে সন্নিবেশিত কবিতা, নামকরণের কবিতা বিশ্লেষণে।
পরিশেষে বলা যায় আধুনিক বাংলা সাহিত্যের বিশাল কাব্যাকাশে "নিভৃতে নির্বাসনে" কাব্যগ্রন্থের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কবিতাগুলো পাঠে যে কোনো কবিতা প্রেমিক মনযোগী পাঠকই নি:সন্দেহে এবং নি:সংকোচে বলবেন কি বিষয় নির্বাচন, কি ভাবের অবতারণা, কি চরণ বিন্যাস, কি শব্দ এবং উপমা অলংকার ব্যবহারে প্রায় প্রতিটি কবিতাই হয়ে উঠেছে সার্থক ও এক একটি কাব্যপরমাণু। চারু পিন্টুর আকা প্রচ্ছদ এবং আককাস মাহমুদ এর আলোকচিত্র চমকপ্রদ। সাদা কাগজে ঝকঝকে-তকতকে ছাপা, সুন্দর বোর্ড বাঁধাই ৭৮ পৃষ্ঠা বইয়ের তুলনায় ১৭৫ টাকা মূল্য খুব বেশী নয়। বর্তমান দুর্মূল্যের বাজারে সুন্দর এই প্রকাশনার জন্যে শিখা প্রকাশনীর প্রকাশক নজরুল ইসলাম (বাহার) কে ধন্যবাদ না দিলেই নয়। বইটির বহুল প্রচার কামনা করি।