'পরিবর্ত অনুসন্ধান': ইতিহাসচর্চার এক বিকল্প প্রয়াস

, শিল্প-সাহিত্য

পায়েল দেশমুখ | 2023-08-31 22:21:33

পৃথিবীর প্রতিটি ব্যক্তিই তার সমকালীন সমাজ, আর্থ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও সাংস্কৃতিক ধারার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সম্পর্কযুক্ত। ঠিক একইভাবে প্রান্তিক গ্রামগুলিও তাদের পার্শ্ববর্তী জেলা, রাজ্য, দেশ, রাজধানী, প্রতিবেশি রাষ্ট্র বা বিশ্বের মূল অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চালিকা শক্তি থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। সমকালীন বিশ্ব-ইতিহাসের এইরকম একটি বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে গ্রাম ও মহানগরের সম্পর্ক নিয়ে সাম্প্রতিককালে যেসমস্ত গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে তাদের মধ্যে এক ব্যতিক্রমী পদক্ষেপ হল ড. রূপ কুমার বর্মণের লেখা ‘পরিবর্ত অনুসন্ধান: রাষ্ট্র, নাগরিকত্ব, বাস্তুচ্যুতি ও ইতিহাসচর্চা’ গ্রন্থটি [রূপ কুমার বর্মণ: পরিবর্ত অনুসন্ধান: রাষ্ট্র নাগরিকত্ব বাস্তুচ্যুতি ও ইতিহাসচর্চা, কলকাতা: গাঙচিল, ২০২২,পৃষ্ঠা: ১৭০, মূল্য: ৪৫০/ ভারতীয় টাকা]। একজন ব্যক্তির নিজের জীবনের যাত্রাপথের সঙ্গে তার সমকালীন বিশ্বকে সম্পর্কযুক্ত করার এক অনন্য প্রয়াস হল এই ‘পরিবর্ত অনুসন্ধান’।     

এই যাত্রাপথের বর্ণনা লেখক শুরু করেছেন ভুটানের পাদদেশে অবস্থিত আলিপুরদুয়ারের রায়ডাক তীরের ছোট চৌকির বস গ্রাম থেকে। প্রকৃতির কোলে অবস্থিত এই গ্রামের পথ থেকে লেখক পাঠককে বিচরণ করিয়েছেন মহাকালগুড়ি, শামুকতলা, কামাক্ষ্যাগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, শিলিগুড়ি, নকশালবাড়ি, দার্জিলিং , কোচবিহার ও কলকাতার রাজপথে। তাঁর এই পুরো যাত্রায় পাঠকের সামনে দৃশ্যকল্পের মতো প্রস্ফুটিত হয়েছে উত্তরবঙ্গ, আসাম, বাংলাদেশ, ভুটান ও নেপালের ভূপ্রকৃতি, জনজীবনের বৈচিত্র্য, সংস্কৃতি এবং নাগরিক জনজীবন। লেখকের ঐতিহাসিক সত্ত্বা, তাঁর লেখনীর মধ্যে ফুটিয়ে তুলেছে ১৯৭০ থেকে২০২২,  এই সময়পর্বের ঐতিহাসিক ঘটনাবলী ও তার ইতিহাসচর্চাকে।

চারটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত ‘পরিবর্ত অনুসন্ধানের’ প্রথম অধ্যায়ে লেখক আলোচনা করেছেন তাঁর শৈশব ও ছোট চৌকির বস গ্রামের কথা। এই গ্রামের ভৌগলিক ও জনজীবনের বৈচিত্র্য আলোচনা করে লেখক দেখিয়েছেন কীভাবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ঘটনাবলীর দ্বারা এই প্রান্তিক অঞ্চলটি প্রভাবিত হয়েছিল। প্রথম অধ্যায়ে আমরা দেখি মহাকালগুড়ি মিশন স্কুলে পড়ার সময় ঐ অঞ্চলের বহুমুখী সংস্কৃতির সঙ্গে লেখক খুঁজে পান বিশ্ব ইতিহাসের চালিকা শক্তিকে। এমনকি তার কিশোর মনের কল্পনায় মাহাকালগুড়ি গ্রামে তিনি খুঁজে পেয়েছেন William Wordsworth (1770-1850) এর কবিতায় বর্ণিত ইয়ুরোপের গ্রামের সাদৃশ্য। আলিপুরদুয়ার কলেজের ছাত্রজীবনের প্রসঙ্গে লেখকের কলমে উঠে এসেছে ঔপনিবেশিক বাংলার রাজনীতি (১৭৫৭-১৯৪৭), ডুয়ার্সের গণ-আন্দোলন (১৯২০-১৯৪২) , আসাম আন্দোলন (১৯৭৭-১৯৮৫), পশ্চিমবঙ্গের  পশ্চিমবঙ্গের  বামপন্থী রাজনীতি (১৯৪৭-২০১১) ও আঞ্চলিকতার আন্দোলন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ (১৯৭১), শীতল যুদ্ধ (১৯৪৫-১৯৯১), সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গন, Paris Principles (1991), মানবাধিকার ও বিশ শতকের স্বৈরাচারী শাসনের কথাও। অর্থাৎ ১৯৮০ ও ১৯৯০ দশকের প্রেক্ষাপটে নিজের ব্যাক্তি-জীবনের সঙ্গে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে লেখক পাঠকের সামনে নতুন বিশ্বকে তুলে ধরেছেন।

আলোচ্য গ্রন্থের দ্বিতীয় অধ্যায়ের আখ্যান পর্ব গড়ে উঠেছে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখকের ছাত্রজীবন তথা দার্জিলিং শহরের আবহে। এই পর্বে লেখক তাঁর এক ব্যাক্তিগত যাত্রার বর্ণনা দিতে গিয়ে তুলে ধরেছেন ‘নকশালবাড়ি আন্দোলনের’ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। একজন তীক্ষ্ণমেধার ঐতিহাসিক হিসাবে বিশ শতকের শেষ তিন দশকের ইতিহাসচর্চার নতুন ধারারগুলির সঙ্গেও পাঠককে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন ‘পরিবর্ত অনুসন্ধানের’ লেখক। এই অধ্যায়ের শেষে দেখা যায় লেখক প্রবেশ করছেন তার পেশাগত জীবনে।

তৃতীয় অধ্যায়ের সূচনাতে রূপ কুমার তাঁর পেশাগত জীবনের (সেন্ট জোসেফ কলেজ এবং পরবর্তীকালে এ.বি.এন শীল কলেজের সহকারী অধ্যাপক) বর্ণনা করতে গিয়ে কোচবিহার রাজ্যের সূচনা, তার বিকাশ তথা গণস্মৃতির (public memory) ইতিহাস আলোচনা করেছেন। একইসঙ্গে বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রের World Trade Centre)  সদর দপ্তরে জঙ্গী আক্রমণ (২০০১) ও ডারবান সম্মেলন (২০০১) প্রসঙ্গে লেখক বর্ণবাদের (Racism) সঙ্গে ঔপনিবেশিক জ্ঞানচর্চার সম্পর্ক এবং বাংলার ইতিহাসচর্চায় তার প্রভাবের বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন।

চতুর্থ অথ্যায়ের সূচনায় লেখক ভারতের এক বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যোগ দেয়ার সূত্রে তুলে ধরেছেন বাস্তুচ্যতি, বর্ণবাদিতা (Casteism) এবং গ্রাম ও মহানগরের জীবনের বৈপরীত্যের ইতিহাস। তবে এই অধ্যায়ে ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতার থেকেও বেশি প্রাধান্য পেয়েছে ইতিহাসচর্চার ধারাগুলি। বিশ ও একুশ শতকের আবহে সৃষ্ট ‘পরিবেশের ইতিহাস’, রাষ্ট্র নির্মাণ, বাস্তুচ্যুতি ও নাগরিকত্বের দ্বন্দ; বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও চিকিৎসা; এবং দলিত প্রতর্ক সম্পর্কিত ইতিহাসচর্চায় আলোকপাত করতে গিয়ে ‘পরিবর্ত অনুসন্ধানের’ লেখক পাঠককে মনে করিয়ে দিয়েছেন সাধারণ মানুষের (Common People) ইতিহাস শুধু লেখ্যাগারের তথ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। যাইহোক, শেষ অধ্যায়ে আমরা দেখেছি  যে ঐতিহাসিকের নৈপুণ্যতা ও ইতিহাসচর্চার  পদ্ধতির ব্যবহারে এই গ্রন্থটি ব্যক্তিগত স্মৃতিকথাকে অতিক্রম করে গেছে।

সামগ্রিকভাবে বলা যায়  ‘পরিবর্ত অনুসন্ধান’ একটি ‘ অভিনব স্মৃতিকথা’ যা প্রকৃতপক্ষে জাতি, রাষ্ট্র ও বৃহত্তর সমাজের সঙ্গে ব্যাক্তি-জীবনের আশ্চর্য মিশেল। তবে প্রথাগত আত্মজীবনী থেকে  ভাবগতভাবে এই গ্রন্থটি অনেকটাই পৃথক। কারণ বিশ্ব-সমাজের মধ্যে ব্যক্তির অবস্থান বা প্রান্তিক অঞ্চলের সঙ্গে বিশ্বের সংযোগের ইতিহাস নির্মাণ করতে গিয়ে লেখক প্রকৃতি, মানুষ ও তাদের ভবিষ্যতের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। লেখকের অন্যতম প্রেরণা সাহিত্যিক অদ্বৈত মল্লবর্মন (১৯১৪-১৯৫১)  উপন্যাসের মধ্যে জলজীবনের গাথা অঙ্কনে যে কাব্যিক স্বাধীনতা গ্রহণ করেছিলেন, সেই স্বাধীনতাটুকুকেই পরিহার করে ছন্দময় গাথার উত্তরাধিকার লেখক বহন করেছেন বর্তমান গ্রন্থে। 

রূপ কুমার বর্মণ: পরিবর্ত অনুসন্ধান: রাষ্ট্র নাগরিকত্ব বাস্তুচ্যুতি ও ইতিহাসচর্চা, কলকাতা: গাঙচিল, ২০২২,পৃষ্ঠা: ১৭০, মূল্য: ৪৫০/ ভারতীয় টাকা

পায়েল দেশমুখ, গবেষক, ইতিহাস বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা, ভারত।

এ সম্পর্কিত আরও খবর