‘রাজবংশী জাতির জনক’ পঞ্চানন বর্মা

, শিল্প-সাহিত্য

ড. রূপ কুমার বর্মণ | 2023-09-01 20:51:02

উপমহাদেশের সভ্যতা ও সংস্কৃতির মূল ধারক ও বাহক হিসাবে ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মূলবাসিন্দাদের (indigenous) অবদান ও অবস্থান ভারতীয় উপমহাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের পণ্ডিত ও গবেষকগণের আলোচনার অত্যন্ত প্রিয় বিষয়। কিন্তু পাশ্চাত্য ভাব ও চিন্তাধারার দ্বারা আচ্ছাদিত বিদ্বৎসমাজ (বা পণ্ডিতকূল) এদের আর্থ-সামাজিক অবস্থান ও সাংস্কৃতিক অবদানকে তথাকথিত মূল সংস্কৃতির পরিধির বাইরে রাখার প্রয়াসে সবসময় যত্নশীল। তাই ঔপনিবেশিক আমলের প্রান্তিকায়িত জনগোষ্ঠীর কোন সুশিক্ষিত ব্যক্তির স্বাধীনতা আন্দোলন ও জাতিগঠনের অবদানকেও ঔপনিবেশিক শাসনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে। কিন্তু তাঁদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে বাদ দিয়ে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বাংলা (এমনকি ভারতের) পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনা করা প্রায় অসম্ভব।

উদাহরণ হিসাবে এখানে আমরা ঔপনিবেশিক বাংলা ও ঔপনিবেশিকোত্তর পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের রাজবংশী জনগোষ্ঠীর কথা বলতে পারি। ঔপনিবেশিক সরকার ও তাঁদের সহযোগীদের (agent বা collaborators) বিরুদ্ধে বাংলার কৃষকদের প্রথম  (রংপুর বিদ্রোহ, ১৭৮৩) ও শেষ (তেভাগা, ১৯৪৬) সংগ্রামে রাজবংশী কৃষকদের অংশ গ্রহণ সর্বজনবিদিত। আবার বাংলার সংস্কৃতির গোষ্ঠীকেন্দ্রিক সঙ্গীতের উদাহরণ হিসাবে (আরোও কয়েকটি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সঙ্গে) রাজবংশীদের ভাওয়াইয়া সঙ্গীতের কথাও উঠে আসে।

বিশ শতকের গোড়ায় প্রথম যখন উচ্চবর্ণীয় হিন্দুরা ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের শুরু করেছিলেন বা মুসলমানগণ তাঁদের সার্বিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের চিন্তাভাবনা শুরু করেছিলেন সেই সময়ে রাজবংশীরাও পিছিয়ে ছিলেন না। তাঁরা তাঁদের মতো করে রাজনৈতিক ও সামাজিক মুক্তির আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন। এক্ষেত্রে মূল ঋত্বিক ও অনুঘটক  ছিলেন পঞ্চানন বর্মা (১৮৬৫-১৯৩৫)। তিনি শুধুমাত্র রাজবংশী জাতির জনকই হয়ে ওঠেন নি, তিনি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন প্রান্তিক মানুষের প্রেরণাদাতা হিসাবে যিনি রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকারকে সুনিশ্চিত করার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন।

পঞ্চানন বর্মার পিতৃদত্ত পদবি ছিল ‘সরকার’। পিতা খোসাল চন্দ্র সরকার ও মাতা চম্পলদেবীর পুত্র পঞ্চাননের জন্ম হয় ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে কোচবিহার রাজ্যের মাথাভাঙ্গা মহকুমার খলিসামারি গ্রামে। কোচবিহারের জেনকিন্স স্কুল ও ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে পঞ্চানন সরকার সাফল্যের সঙ্গে এফ. এ., বি. এ., এম. এ. (সংস্কৃত) এবং বি. এল. শিক্ষা সমাপ্ত করেন। কিন্তু রাজানুগ্রহ না থাকায় কোচবিহার রাজ্যে তিনি কোন উপযুক্ত কাজ পাননি। তাই ব্রিটিশ বাংলার রংপুরে তিনি তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন (১৯০১) একজন আইনজীবী হিসাবে। একই সঙ্গে তিনি নিজেকে যুক্ত করেছিলেন সুরেশচন্দ্র রায়চৌধুরীর প্রতিষ্ঠিত বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের রংপুর শাখার সঙ্গে। এই শাখার সাহিত্য পত্রিকার প্রথম সম্পাদক হিসাবে পঞ্চানন সরকার (বর্মা) তাঁর অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে আবিস্কার করেছিলেন ‘গোবিন্দ মিশ্রের গীতার’ পুঁথি। এই পত্রিকায় তিনি প্রকাশ করেছিলেন ‘দ্বিজকমল লোচনের চণ্ডিকাবিজয় কাব্যের টীকা' (১৯১৫), ‘কামতাবিহারী সাহিত্য’ শিরোনামের প্রবন্ধ (১৯১০) ও বেশ কয়েকটি কবিতা। অর্থাৎ ভারতের জাতীয় ইতিহাসের প্রেক্ষিতে পঞ্চাননের ‘কথা বলা’  ও ‘লেখার যোগ্যতা’ প্রমানের জন্য এই কয়েকটি উদাহরণই যথেষ্ঠ।

কিন্তু এই যোগ্যতা তাঁকে জাতপাতের অভিশাপ থেকে মুক্তি দিতে পারেনি। পঞ্চাননকে তৎকালীন বাংলার উচ্চবর্ণীয় হিন্দুদের জাতিগত অহংকারের আঘাতে জর্জরিত হতে হয়েছিল রংপুরের আদালত চত্বরে। তাঁর উকিল সহকর্মী জনৈক মৈত্র সাহেব তাঁর রাজবংশী জাতি পরিচয়ের জন্য পঞ্চাননকে জনসমক্ষে অপমান করেছিল। তাই পঞ্চাননের পক্ষে সামাজিক অন্যায়ের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করা ছাড়া অন্য কোন উপায় খোলা ছিল না।

পঞ্চাননের নেতৃত্বে রাজবংশীদের সামাজিক ন্যায়বিচার অর্জন ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট সূচিত হয়েছিল উনিশ শতকে ব্রিটিশ সরকারের দ্বারা আদমসুমারির প্রবর্তন (১৮৭২) ও ভারতের জনগণের সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসের পদক্ষেপের দ্বারা। একদিকে ইউরোপীয় চিন্তাজগতের Racial Superiority-র আমদানি ও অন্যদিকে ভারতীয় উচ্চবর্ণীয়দের সামাজিক প্রতিপত্তি,  এই দুয়ের তাত্ত্বিক চাপে উত্তরবঙ্গের রাজবংশীগণ অত্যন্ত নিম্নমানের জীব হিসাবে সরকারি প্রতিবেদনে লিপিবদ্ধ হন (১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে)। রংপুরের জেলাশাসক ‘কোচ’ ও ‘রাজবংশী’ উভয়কেই একই শ্রেণির মানুষ হিসাবে বর্ণনা করায় রংপুরের রাজবংশীদের প্রভাবশালী অংশ তা মেনে নিতে পারেননি।

কিন্তু ১৮৯১ ও ১৯০১ এর আদমসুমারিতে রাজবংশীদের ‘ক্ষত্রিয়’ জাতির দাবি স্বীকৃত হয়নি। ১৯১০ এ আদমসুমারির প্রক্রিয়া পুনরায় শুরু হলে পঞ্চানন তাঁর সহযোদ্ধাদের নিয়ে রাজবংশীদের ক্ষত্রিয়ত্বের দাবিতে অগ্রসর হন। ১৯০১ থেকে ১৯১০-এই দশ বছরে উচ্চবর্ণীয়দের দ্বারা রাজবংশীদের  (ও তাঁর নিজের) সামাজিক নিষ্পেষণের যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল, তা তাঁকে রাজবংশীদের ক্ষত্রিয়ত্ব প্রতিষ্ঠার পথে চালিত করেছিল। এটাকে তিনি বাস্তবে সামাজিক অন্যায়ের (Social Injustice) বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও সামাজিক মর্যাদা (Social Dignity) অর্জনের প্রতীক হিসাবেই  গ্রহণ করেছিলেন।

একথা আজ সকলেরই জানা যে (১৯১০ এ স্থাপিত) রংপুর ক্ষত্রিয় সমিতির তত্ত্বাবধানে ও পঞ্চাননের সুযোগ্য নেতৃত্বে শাস্ত্রীয় ক্রিয়া-অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে রাজবংশীগণ ক্ষত্রিয় পরিচয় অর্জন করেছিল। ক্ষত্রিয়ত্বের পরিচায়ক হিসাবে রাজবংশীগণ বর্মণ, বর্মা, সিংহ, ইত্যাদি উপাধি ব্যবহার শুরু করেন। আর পঞ্চানন সরকার তখন থেকেই পঞ্চানন বর্মায় উত্তীর্ণ হন।

ঔপনিবেশিক ভারতের সামাজিক ইতিহাসের চর্চায় রাজবংশীদের ক্ষত্রিয় আন্দোলন সংকৃত্যায়নের গণ্ডি অতিক্রম করতে পারেনি। মার্কসীয়, সাবলর্টান ও দলিত ইতিহাসে রাজবংশীসহ অন্যান্য নিম্নবর্গীয় জাতির ক্ষত্রিয় বা বর্ণ জাতির আন্দোলন সাধারণত M.N. Srinivas-এর চিন্তার আলোকে ক্ষত্রিয়করণ/ সংকৃত্যায়ন/ ‘সামাজিক উর্ধ্বগমন’ এর মতো ‘ভাবধারণা’ দ্বারা আলোচিত হয়। কিন্তু আমি মনে করি রাজবংশী ক্ষত্রিয় আন্দোলনের এই পর্যায়টি ছিল প্রকৃতপক্ষে উচ্চবর্ণীয়দের সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও সামাজিক উন্নয়নের সূচক হিসাবে নিজস্ব চেতনার বহিঃপ্রকাশ। আবার এটা শুধুমাত্র সামাজিক পরিচিতি নির্মাণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। রাজবংশীগণের সর্বাঙ্গীন উন্নতি সাধনই ছিল এর মূল লক্ষ্য।

পঞ্চাননের আরেকটি সদর্থক প্রয়াস হল রাজবংশীদের উন্নয়নের জন্য রাজানুগ্রহ লাভ করা। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩), ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯০), কেশবচন্দ্র সেন (১৮৩৮-১৮৮৪), জ্যোতিবা ফুলে (১৮২৭-১৮৯০), স্যার সৈয়দ আহমদ (১৮১৭-১৮৯৮); প্রভৃতি সমাজ-সংস্কারকগণ রাজপৃষ্ঠপোষকতাতেই সমাজ-সংস্কার ও আধুনিক শিক্ষা বিস্তারে অগ্রসর হয়েছিলেন। উনিশ শতকের উচ্চবর্গীয় সমাজ সংস্কারকগণ যে উদ্দেশ্য নিয়ে রাজানুগ্রহ প্রার্থনা করতেন বা সরকারের সহযোগী হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, বিশ শতকের গোড়ায় পঞ্চাননও সরকারি সহযোগিতায় রাজবংশীদের সামাজিক, আর্থিক ও রাজনৈতিক উন্নয়নের প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন। তাই পঞ্চাননের নেতৃত্বে ক্ষত্রিয়ত্বের আন্দোলন কেবলমাত্র ‘ক্ষত্রিয়করণের’ মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না ।

পঞ্চানন বর্মা তথা রাজবংশীদের অধিকার অর্জনের দ্বিতীয় পর্যায়টি শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৮) পরবর্তীকালে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের সহযোগিতা করার বিনিময়ে পঞ্চাননের এম.বি.ই (MBE) উপাধি লাভ ছাড়াও ১৯১৯এর ভারতশাসন আইন ব্রিটিশ ভারতের অন্যান্য প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে রাজবংশীদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের পথ প্রশস্ত করেছিল। এই আইন অনুযায়ী বাংলার প্রাদেশিক আইন পরিষদে নির্বাচন ও দায়িত্বশীল সরকার গঠনের ব্যবস্থা হয়েছিল। এই নির্বাচনে অন্যান্য নিম্নবর্ণীয় সম্প্রদায় ও উচ্চবর্ণীয় জমিদারদের  মত পঞ্চানন বর্মা ও ক্ষত্রিয় সমিতি সমর্থিত আরেকজন প্রার্থী (যোগেশচন্দ্র সরকার) অ-মুসলমান আসনে জয়লাভ করেন। পরবর্তী নির্বাচনগুলিতেও ক্ষত্রিয় সমিতি তাঁর জয়ের ধারা অব্যাহত রেখেছিল। ক্ষত্রিয় সমিতি রংপুরের গণ্ডী অতিক্রম করে পার্শ্ববর্তী দিনাজপুর ও জলপাইগুড়িতেও তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল। কোনরকম সংরক্ষণ ছাড়া শুধুমাত্র সাহসিকতা, উদ্যম ও আত্মচেতনার দ্বারা রাজবংশী জাতির তথাকথিত উচ্চবর্ণীয় ও উচ্চবর্গীয়দের বিরুদ্ধে জয়লাভ ও রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হওয়া নিঃসন্দেহে পঞ্চানন বর্মা ও তাঁর সহযোগীগণের দূরদর্শীতার পরিচায়ক।

পঞ্চানন বর্মার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের তৃতীয় পর্যায় শুরু হয়েছিল ১৯৩০-র গোড়ায় বিশেষ করে লন্ডনে গোলটেবিল বৈঠক (১৯৩০-৩২) ও তার ফল স্বরূপ সাম্প্রদায়িক বাটোয়ারা ও নিম্নবর্ণীয় হিন্দুদের জন্য কয়েকটি পৃথক আসন সহ নির্বাচকগোষ্ঠীর ব্যবস্থা গ্রহণের দ্বারা। জাতীয় কংগ্রেসসহ অন্যান্য উচ্চবর্ণীয় হিন্দু প্রভাবিত রাজনৈতিক দলগুলো এই ব্যবস্থাকে হিন্দুদের মধ্যে বিভাজনের প্রক্রিয়া হিসাবে চিহ্নিত করে সাম্প্রদায়িক বাটোয়ারার (Communal Award) বিরোধিতা করেছিল। অন্যদিকে বি. আর. আম্বেদকর (১৮৯১-১৯৫৬) পৃথক নির্বাচনের স্বপক্ষে সওয়াল করায় এক অভূতপূর্ব রাজনৈতিক সংকটের সৃষ্টি হয়। শেষ পর্যন্ত পুনা চুক্তির (১৯৩২) দ্বারা ১৯৩৫ এর ভারতশাসন আইনে ব্রিটিশ ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের বিধানসভায় (Legislative Assembly) তপশিলিদের জন্য আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা হয়।

বাংলায় তপশীলি জাতির জন্য যারা আইন পরিষদে সরব ছিলেন তাদের মধ্যে পঞ্চানন বর্মা ছিলেন অন্যতম। কিন্তু রাজবংশীদের অনেকের মধ্যেই তপশিলিজাতি পরিচিতি নিয়ে সন্দেহ ছিল। এমনকি বাংলার সরকারও প্রথমে রাজবংশীদের তপশিলি জাতির তালিকা থেকে বাদ দিয়েছিল। কিন্তু পঞ্চানন বর্মা ও উপেন্দ্রনাথ বর্মণের প্রচেষ্টায় শেষপর্যন্ত বাংলার রাজবংশীগণ তপশিলি জাতি হিসাবে সংরক্ষণের আওতাভুক্ত হন।

তপশিলি জাতি হিসাবে বাংলার রাজবংশীগণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংরক্ষণের আওতাভুক্ত হন। ১৯৩৫ এর আইন অনুযায়ী প্রথম সংরক্ষণ ভিত্তিক প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৩৭ সালে। জলপাইগুড়ি, রংপুর ও দিনাজপুর মিলিয়ে ১০ জন রাজবংশী প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। এদের মধ্যে দুজন বাদে বাকিরা জয়লাভও করেছিলেন। তবে সবাই রাজবংশী ক্ষত্রিয় সমিতির তত্ত্বাবধানে অংশ গ্রহণ করেননি। তা সত্ত্বেও বলা যায় যে সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকায় রাজবংশীগণ বাংলার রাজনীতিতে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত বাংলার প্রাদেশিক সরকার গঠনে রাজবংশীগণ অপরিহার্য্য অঙ্গে পরিণত হন। আর এখানেই পঞ্চানন বর্মার দূরদৃষ্টির সার্থকতা।

পঞ্চানন বর্মার অভিজ্ঞতা ও কার্যাবলীকে বাংলাসহ ভারতের সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের গতিধারার মধ্যে আলাদা ভাবে আলোচনা করার প্রবণতা, পঞ্চানন বর্মাকে ‘ঠাকুর’, ‘মনীষী’, ‘মহাপুরুষ’, ‘রাজবংশী জাতির জনক’, ইত্যাদি; অভিধায় ভূষিত করেছে। ক্ষত্রিয় জাতির মানুষ হিসাবে যে কোন রাজবংশীই এর জন্য গর্ববোধ করতে পারেন। একই ভাবে তাঁর নামে সেতু, রাস্তা, বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে তাঁর নামে চেয়ার অধ্যাপকের পদ সৃষ্টি রাজবংশী ক্ষত্রিয় আন্দোলনের বৈধতার স্বীকৃতি হিসাবে চিহ্নিত হয়। কিন্তু তাঁকে শুধুমাত্র রাজবংশী জাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে কখনই তাঁর কার্যাবলীর প্রকৃত মূল্যায়ন হবে না। আমরা তাঁকে দেখেছি সামাজিকভাবে নিপীড়িত জাতির আত্মমর্যাদা ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সামিল হতে। তাঁর হাত ধরেই অসংখ্য তথাকথিত পিছিয়ে পড়া মানুষের সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছিল। সম্ভব হয়েছিল রংপুর সাহিত্য পরিষদের মূর্ত হয়ে ওঠা। তাই বলা যায় যে ‘পঞ্চানন বর্মার মত মানুষেরা কথা বলতে জানেন, শাসক ও শাসিতের ভাষায় লিখতে জানেন, ন্যায়বিচারের আন্দোলন করতে জানেন, অধিকার অর্জনের জন্য লড়াই করতে জানেন, জানেন নারীর সম্মান ও সম্ভ্রম রক্ষার জন্য নারীকেই প্রশিক্ষিত করতে’। তাই আমাদের মার্ক্সীয়, সাবলর্টানীয় ও দলিত ইতিহাস চর্চার দৃষ্টিভঙ্গীর বাইরে বেড়িয়ে পঞ্চানন বর্মাকে বিচার করতে হবে। এর দ্বারাই আমরা তাঁর অবদানের প্রকৃত মূল্যায়নে সক্ষম হব।

লেখক: কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক

এ সম্পর্কিত আরও খবর