(এক)
কিছু কবি থাকেন একান্ত নিজের মতো। বিচিত্র বোধের দিগন্ত ঘুরে এসে খুঁটি বাঁধেন নিজের রুচির বীজতলায়। এখানেই বোপন হয়, রোপণ হয়, চাষ হয় নিজস্ব চিন্তা চেতনার। যাদের আলোকিত অবদানে নিজেরা হৃদ্য, ঋণ স্বীকার করতে গিয়ে তাদের প্রতি দেখান অকৃত্রিম সম্মান ও ভালোবাসা। কবিতায় প্রকাশ করতে চান তাদের অমরত্ব। সাঈদ চৌধুরীর কবিতা পড়লে আপাতত তা-ই মনে হবে নবীন পাঠকের। যদিও এটা একটা স্টাইল বা তাঁর কাব্য ঠিকানা আবিষ্কারের একটি সুন্দর চাবি। সাঈদ চৌধুরীর ভার্চুয়াল আকাশে ভাসানো ৫২টি কবিতার মধ্যে দুটো কবিতা আধুনিক বাংলা সাহিত্যের কাব্যকোবিদ আল মাহমুদকে নিয়ে।
(দুই)
সব কবির স্থান সব কবির হৃদয়ে হয় না। সাঈদ চৌধুরীর ‘আত্মার অলিন্দে’ নিজ কাব্যগুণে স্থান পাওয়া কবিদের ভিড়ে আল মাহমুদ উজ্জ্বলতম। তাঁর তাবৎ সৃজনশস্য পাঠককুলের সেবনোপযোগি করে একটিমাত্র কবিতার থালায় রাখার বিরল প্রচেষ্টা, ‘রুপালি আলোয়' কবিতাটি ছড়াচ্ছে কবি’র প্রতি কবি’র অপার ভালোবাসা। ছড়াচ্ছে এক নিমিষেই আল মাহমুদের অনুপম আলো।
‘তুমি এলে আগুনের ফুলকির মতো/ রৌদ্র কিরণে ঝলসিত চারিদিক/ উচ্ছ্বাস আনন্দ ছড়িয়ে মুখরিত/ ছেলেবুড়ো আনন্দে দিক-বিদিক।/ উনুনের ধার ঘেঁষে দাই মা/ আয়াতুল কুরছি পড়ে/ আগুনের আঁচে বসে তা দেয়/ সফেদ কাপড়ের ভাজে, জিন-ভূত/ যেন আসেনা ঘরে।/ ছায়ারৌদ্র মেঘের খেলা/ বনশ্রী প্রফুল্ল হয়ে ওঠে/ দীপ্ত রাঙ্গা উদয়ের বেলা।
গ্রীষ্মের দাবদাহ মুছে যায়/ সোনার রবি ছড়ায় কিরণ/ মরু মুষিকের উপত্যকা’য়।/ যেভাবে বেড়ে ওঠি প্রাণের স্পন্দনে/ জ্যোতিস্রোতে মিশেছে প্রিয় স্বদেশ/ জীবন্ত মুক্তিসংগ্রামে কাবিলের বোন/ স্বাধীনতার স্বপ্ন জাল বোনে উপমহাদেশ।/ কবির আত্মবিশ্বাস কবির কররেখা/ আগুনের মেয়ে অর্ধেক মানবী/ নিশিন্দা নারী যতই হোক দেখা।/ কবির সৃজন বেদনা কবিতার আঁচল/ দশ দিগন্তে উড়াল ডাহুকী দিনযাপন/ কবিতার জন্য বহুদূর কবি ও কোলাহল।/ তুমি, আরব্যরজনীর রাজহাস/ আমি, দূরগামী/ প্রহরান্তের পাশ ফেরা এক চক্ষু হরিণ/ পাখির কাছে ফুলের কাছে/ কালের কলস- কিরণ ছড়ায়।/ তুমি, সোনালি কাবিন/ মায়াবী পর্দা দুল ওঠো/ বখতিয়ারের ঘোড়া’য়।/ তুমি, অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না/ প্রহরান্তের পাশফেরা, দোয়েল ও দায়িতা/ লোক লোকান্তর- বিদ্যুৎ চমকায়।
তোমার ভরাট গলার সুকণ্ঠ উচ্চারণ/ মেঘমালা হয়ে উড়ছে হাওয়ায়/ শ্যামল শ্যামল নীলিমায়।/ সৌরভসিক্ত আল মাহমুদ/ বাংলাভাষা হয় গতিময়/ তোমার দৃপ্ত রুপালি আলোয়।’
না। এতটুকুতে পূরণ হয়নি আল মাহমুদের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা-ভালোবসার ক্ষুৎপিপাসা। 'আত্মার অলিন্দে' বইটির আরেকটি কবিতা নিবেদিত ‘আল মাহমুদ, আকাঙ্ক্ষার তীব্র মেঘমালা’।
’আমি দুর্দান্ত ধূসর সমভূমিতে/ মধ্যরাতে দ্রুত হেটে যেতে যেতে/ একটি ছায়ার সামনে দাঁড়িয়েছি।/ তোমার পায়ের চিহ্ন, সফেদ চেহারা/ আমি ছাড়া আর কেউ দেখতে পায়নি!/ তোমার দর্শনে কারা যেন দাঁড়িয়ে আছে/ যেখানে পুরুষ এবং মহিলারাও ছিল/ কোথায় চলে গেল, তোমাকে দেখেনি?/ তোমার কবিতার সুকন্ঠ উচ্চারণে/ আমার হৃদয় আনন্দে ভরে উঠল।/ ভালবাসার পরিপূর্ণতায় যেন আবদ্ধ/ উল্লাসে ঝলমলে তারকার তরঙ্গগুলি/ এই মহিমাময় পৃথিবী ও মঙ্গলগ্রহ।/ তুমি বলেছ, চাঁদের মাঝখানে চিত্র আছে/ বাংলার স্বাধীনতার পতাকার বৃত্তের মত।/ সবুজ গাছের পর মনোরম চারণভূমি/ পাহাড়ের গায়ে ঝলমলে চাঁদের আলো/ অভ্যন্তরীণ চোখে এক ঝলক দেখা হলো!/ আমার জন্য এটাই নির্জনতার আনন্দ/ আল মাহমুদ, আকাঙ্ক্ষার তীব্র হে মেঘমালা!’
নজরুলের আগমনও সাঈদ চৌধুরীর 'আত্মার অলিন্দে' সতঃস্ফুর্ত ঝড়ের মতো। ‘শৈল্পিক সুষমায় নজরুল‘ কবিতায় তা পরিস্ফুটিত হয়েছে। বিশিষ্ট আবৃত্তিকার নাসিম আহমদের কন্ঠে যা ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে।
’কবি নজরুল, তুমি প্রভাতের সোনালী সূর্য/ এক হাতে বাঁশের বাঁশরি, অন্য হাতে রণতূর্য/ শুদ্ধ অনুভবের অনাবিল শৈল্পিক সুষমায়/ তুমি জন্মেছিলে নান্দনিকতার শ্রাবণ ধারায়/ কুয়াশা ভেজা সন্ধ্যা ও মুঠো ভরা জোৎস্নায়/ গোলাপের কলিতে আর শিশির সিক্ত সবুজ ঘাসে/ বৃষ্টির ফোটা গুলো ধরতে তুমি আপন ভালবাসায়।/গ্রীষ্মের রোদেলা তপ্ত দুপুরে নিস্পেশিত/ নিপীড়িতের প্রতিবাদী কন্ঠে তোমাকে পাই/ অলঙ্করণে অভিনব সৌন্দর্যে সুশোভিত/ কবিতার পরতে পরতে জীবনের জয়গান গাই/ এক অপূর্ব মুগ্ধতা, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়/ তোমার সাথে আমার ভাবের লেনাদেনা হয়/ প্রতিদিন সুবহে সাদেকে আর গোধূলী বেলায়।/ তিমির রাত বিদূরিত, নব প্রভাতের অরুণোদয়/ আলোকে উদ্ভাসিত বাংলা, বিদ্রোহী কবির অভ্যুদয়/ সার্বভৌম চেতনা ও প্রেরণায় জাতীয় কবি নজরুল/ বাংলার গৌরব, কোটি মানুষের হৃদয়ে প্রস্ফুটিত ফুল/ বিরহ-বেদনায়, বিদ্রোহের তেজোদীপ্ত উত্তেজনায়/ পরাধীনতার শৃঙ্খলে ও স্বাধীনতার জ্বলন্ত অগ্নিশিখায়/ মায়াময়-ছায়ায় এক ব্যঞ্জনার প্রাণদীপ্ত জীবন ধারায়।’
’সৃষ্টির হিরন্ময় বিস্ময়’ কবিতায় সাঈদ চৌধুরীর ভাষায় পাই নজরুলের প্রাণময় ঢেউয়ের আওয়াজ-
’কাজী নজরুল, বিদ্রোহী কবি স্বমহিমায় উজ্জ্বল/ বাংলার জাতীয় কবি, অপূর্ব বর্ণাঢ্যতায় সমুজ্জ্বল/
নিরন্ন বুভুক্ষ ও বঞ্চিত মানুষের প্রেরণার আশ্রয়/ জাতির মননে আন্দোলিত সৃষ্টির হিরন্ময় বিস্ময়।/ কাব্য সাহিত্যের যুগস্রষ্টা, অমৃত অহঙ্কার/ ব্রহ্মাণ্ডের দ্যুতিময় প্রেমময় শব্দ-ছন্দ-অলঙ্কার/ বহুমাত্রিক কবিতায় অগ্নিঝরা বিদ্রোহের সাজ/ বর্ণিলতা মিশ্রিত যেন প্রাণময় ঢেউয়ের আওয়াজ।/ কবিতার শরীরে প্রাণবন্ত বসন্তের তাজা ফুল/ ময়ূরের অলঙ্কারে যেন সাজানো কানের দুল/ জ্বলজ্বল চোখে বিরহ, বিপ্লব, দ্রোহ মানবতাবাদ/ কী এক মধুর তানে বহুমাত্রিক কাব্যের চাষাবাদ।/ সৌরভে গৌরবে সৌন্দর্যের নিরন্তর প্রেরণায়/ গজল সঙ্গিতে পথিকৃৎ পরম অধ্যাত্ম চেতনায়/ অবিনাশী শক্তি, অমরত্বের সঞ্জীবনী আস্বাদন/ যুগ যুগ ধরে ছড়াবে কবিতার স্বাদ, অবগাহন।’
(তিন)
সমকালীন পৃথিবীর তাবৎ সমস্যা প্রায় প্রতিটি কবি মনে দুঃখ-প্রতিবাদের ঝড় তোলে। কবি সাঈদ চৌধুরীও এ দলের গর্বিত সদস্য। সত্য কথাখানা এই- যে তার সমকাল নিয়ে লিখে, সে প্রকৃতপক্ষে মহাকালের লেখক।
সাঈদ চৌধুরীর 'আত্নার অলিন্দে' কবিতাগ্রন্থে অনেক উল্লেখযোগ্য কবিতা আছে কোভিড ১৯ নিয়ে রচিত। যেখানে মানবজাতির প্রতি কবির অকৃত্রিম দরদ ও ভালোবাসা ফুটে উঠেছে। যেমন- বন্ধু আমার চলে গেছে অনেক দূরে/ তার স্মরণে নিরব শোকের কবিতা... (ক্ষমা করে দিও প্রিয়তম)
মা'কে নিয়ে রচিত কবিতাগুলো গ্রন্থটির মানচিত্রকে অনন্য উচ্চতায় উপস্থাপন করেছে। এই কবি অত্যন্ত সহজ ভাষায় মূল্যবান কথা বলার মুন্সিয়ানা আয়ত্ব করেছেন। যা তার কবিতা কৌশলের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেমন- ‘মমতাময়ী মা’।
‘মা, তুমিই তো পৃথিবীতে স্মিত হাসিতে আমাকে স্বাগত জানিয়েছ। তুমি না বলেছিলে, আমার মহান পিতার আনন্দাশ্রু আলিঙ্গন ও আযান ধ্বনি সুবহে সাদেক মাড়িয়ে বাঙময় হয়ে উঠেছিল পূর্বাকাশের রক্তিমাভায়।/ মহান প্রভুর কাছ থেকে আমার পৃথিবীতে তৃপ্তি এনে দিয়েছ এবং আমার বিশ্বকে করেছ আলোকিত।/ মা, তুমি আমার মনটা আনন্দে আর জীবনটাকে ভালবাসায় পূর্ণ করে দিয়েছ। প্রথম নিঃশ্বাস থেকেই আমাকে আলতো করে ধরে মাথায় বুলিয়েছ তোমার হাত।/ তুমিই তো শিখিয়েছ, কীভাবে প্রতিবেশীকে সালাম জানাতে হয়, নিকটাত্মীয় আর গরীব মানুষকে হাসি দিয়ে করতে হয় বরণ।/ মা, আমি প্রতিদিন বার বার তোমার হাতটি ধরতাম, গরীব ও এতিমের জন্য তোমার দানের কলসে চাল ভরে রাখতাম।/ তুমিই তো আমাকে বরকতময় কল্পনা শিখিয়েছ, কেমন করে স্বপ্নের জাল বুনতে হয়। আমার বাবার সাথে তোমার নিখাদ ও পরিতৃপ্ত ভালোবাসা, আমার ও আমার সন্তানদের জন্য আশির্বাদ হয়ে আছে।/ মা, প্রতিদিন প্রতিমুহুর্ত তোমার চুম্বন ও স্মিত হাসি আর পিতার আনন্দাশ্রু আলিঙ্গন জন্ম দিনের গল্পগুলিকে করে রেখেছে স্মৃতিময়।/ বিদায় বেলাও তুমি আলতো করে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছ। হাতগুলি ধীরে ধীরে আমার মুখ ও বুক ছুয়েছিল। স্পর্শ করেছিল হৃদয়। /রাব্বির হা‘ম হুমা- কামা- রাব্বায়া-নি- সাগী-রা।’
(চার)
কবিতা সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে সঠিক পথ দেখায়। কবিরা আহবান করেন চিরন্তন সত্য সুন্দরের পথে। ক্ষমতাবানকে বলেন- ক্ষমতার অপব্যবহার করোনা। বেপরোয়া রাজনীতিককে বলেন- টিকবেনা তোমার দৌরাত্ম্য। অতএব সাবধান হও।
অসুস্থ সমাজদেহের ওপর কবি সাঈদ চৌধুরী'র দৃষ্টি অত্যন্ত তীক্ষ্ণ। ‘মাফিয়াদের উল্লাস নৃত্য' কবিতায় তিনি বলিষ্ট সাহসিকতার সাথে দেশ ও সমাজচিত্র তোলে ধরেছেন এভাবে -
‘আনন্দশূন্য দেশের মানুষ, শ্রমজীবী মেহনতি জনতা/ লুটেরা হয়েছে আজ সমাজ ও জাতির ভাগ্য বিধাতা।/ হাতিয়েছে অঢেল সম্পদ, বেড়েছে অহমিকা ও আমিত্ব/ সার্বভৌম স্বদেশে চলছে শুধুই মাফিয়াদের উল্লাস নৃত্য।/ ক্ষমতার মদমত্তে জীবন কেটে যাবে অনাবিল আনন্দে/ আমজনতা থাকুক জ্বরাক্রান্ত, বিষাদ আর নিরানন্দে।/ হিংসা-বিদ্বেষ ছড়িয়ে তারা জঘন্য পাশবিকতায় লিপ্ত/ অনাচার-পাপাচারে নেই কোন আত্মগ্লানি, নয় অনুতপ্ত।/ ঔদ্ধত্যের চিরকালীন অলিক স্বপ্ন হয়না কখনো পরিপূর্ণ/ পেতে হবে কৃতকর্মের মাশুল, দাম্ভিকতা হবে চূর্ণ-বিচূর্ণ।/ ক্ষমতার আধিপত্যে যারা রাহাজানি আর লুটপাটে মত্ত/ দুঃসময়ে পাবেনা যে নিষ্কৃতির পথ, ওরা চির অভিশপ্ত।’
স্বাধীনতা একটি জাতির জীবনে সর্বাপেক্ষা মূল্যবান ঘটনা। অর্ধ শতাব্দী কাল পেরিয়ে এসেও আমাদের স্বাধীনতার দেহে রক্তপাত কবিকে নিষ্ঠুরভাবে আক্রান্ত করে। ‘রক্তাক্ত স্বাধীনতা' কবিতায় সাঈদ চৌধুরী বলছেন-
‘আগ্রাসন আর পরাধীনতা ছেয়েছে আজ পৃথিবীকে, দিকে দিকে/ সুবর্ণ জয়ন্তীতে রক্তাক্ত স্বাধীনতার দেহ, গুলিবিদ্ধ লাশ/ ট্রিগারে রাখা হাত, মোদিবাহি সন্ত্রাস!/ শাহাদাতের/ সুধা পান করে/ প্রতিবাদী জনতা।/ রক্ত দিয়ে উদযাপন/ রক্ত দিয়ে কেনা স্বাধীনতা/ স্বাধীনতার সার্বভৌম পরাধীনতা!/ বাহারি আলোর ঝলকানিতে মেতেছে/ কিছু সংখ্যক দলদাস, আধিপত্যবাদের সেবাদাস/ অন্ধ-বধির আত্মহারা, তবুও তারা জ্ঞানের ফেরিওয়ালা!/ নরেন্দ্র মোদি, রক্তের হোলি খেলায় নেই কোন জুড়ি তার/ ধিক্ ধিক্ ধিক্কার! জাগ্রত জনতার। সংগ্রামী মমতার।/ তবুও নেই তার পরিতাপ! অফুরান অভিশাপ!’
এ বিষয়ে কবির আশাবাদ আমাদের দারুণ উৎসাহিত করে। ‘আলোকদীপ্ত’ কবিতায় তার উদ্ভাসিত উচ্চারণ- ‘তথ্য সন্ত্রাস আর পাকানো মিথ্যা দিয়ে/ কেউ তোমাকে ময়লা করে ফেলতে পারে/ তবুও, ধূলোর মতো তুমি উঠবে।/ কুকুরটিকে সরস হাড়ের সাহায্যে/ ঘেউ ঘেউ করা থেকে বিরত করো না।/ কোন বাঁকা পথ অনুসরণ করে নয়/ সত্য সেখানে, সমস্ত মিথ্যা যেখানে সমাপ্ত।/ রাত পোহাবে, সম্মুখে আলোকদীপ্ত বেলা/ রৌদ্রের কিরণে মিথ্যুক পালাবে নিৰ্জন পথে/ নিশ্চয়ই, সূর্যের মতো তুমি উঠবে।’
(পাঁচ)
বন্ধুত্ব মানুষের জীবনে অবিকল্প আনন্দের বন্যা নিয়ে আসে। একজন প্রকৃত বন্ধু মানে একজন অকৃত্রিম সংগী, দরদী, হিতাকাঙ্ক্ষী ও দার্শনিক। জনৈক কবি লিখেছেন- 'তব সাথী হয়ে দগ্ধ মরুতে পথভুলে তবু মরি/ তোমারে ছাড়িয়া মসজিদে গিয়া কী হবে মন্ত্র স্মরি।'
চরণগুলোতে যথেষ্ট আবেগ আছে। তারপরও বন্ধুত্বের গুরুত্ব অত্যন্ত স্বচ্ছতার সাথে উদ্ভাসিত। কবি সাঈদ চৌধুরীর কবিতায় হারানো বন্ধুর কথা এসেছে অত্যাধুনিক পোশাক পরিধান করে- ‘আমি টিপটিপ বৃষ্টিতে তাকে মিস করি।'
প্রেম -ভালোবাসাকে বলা হয় জীবনের পাল। মানুষ হয়ে জন্ম নিলে এই পালের হাওয়া গায়ে লাগবেই। সাঈদ চৌধুরীও এর ব্যতিক্রম নন। 'প্রতিদানহীন ভালোবাসা’ কবিতায় লিখেছেন- হৃদয়ের ঐ দূর আকাশে তাকিয়ে দেখো/ ভালোবাসা! শুধুই ভালোবাসা! প্রতিদানহীন ভালোবাসা!
এখানে তার উচ্চারণ কিছুটা কবি গোলাম মোস্তফার মতো- ‘আমার এ ঘর ভাংগিয়াছে যেবা আমি বাঁধি তার ঘর/ আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর।' প্রকৃত কবিরা প্রকৃত ভালোবসার চায় না কোনো প্রতিদান।
(ছয়)
প্রকৃত কবিদের কাছে প্রকৃতি হলো পৃথিবীর স্বর্গ। কবিরা প্রকৃতিদেহ, এর কান্তিময় স্নিগ্ধতা অনুভব করেন অনেক গভীর থেকে। সাঈদ চৌধুরীর অনুভূতিও বেশ আকর্ষণীয়। পাঠক নিশ্চই ‘বর্ণের ঐশ্বর্য’ কবিতা পড়ে আনন্দ পাবেন।
বসন্ত কিংবা শরতের স্নিগ্ধ জ্যোৎস্নায়/ কবিতা যেন বর্ণের ঐশ্বর্যে হৃদয়ের দুল/ সাধের গোলাপ বা রক্তজবা ফুল।/ কবিতা বিশ্রাম দেয় না, সুবহে সাদেকে/ সূর্য দিগন্তের উপরে চলে আসে অবিরত/ সমুদ্রবক্ষে হারিয়ে যাওয়া সূর্যাস্তের মত।/ কবিতা তো প্রিয়তমার সাথে রোজ/ বিকেলে দুই কাপ চা, দুই বাটি স্যুপ/ সপ্তাহান্তে বারান্দায় মধ্যাহ্ন ভোজ।/ কবিতা তো আঙ্গিনায় বৃষ্টির আগমন/ দুর্দান্ত প্রাণময়তার উল্লাসে উপচে পড়া/ নির্মল ভালোলাগা-ভালোবাসা অগণন।/ কবিতার জন্যে যাই সবুজ পাহাড়ের কাছে/ হরেক রঙের অজস্র ফুল ফুটে আছে/ গাছগুলো অভ্র-উজ্জ্বল রং ধরেছে।/ শুভ্রতার জন্য পূর্ণিমা রাতে যাই চাঁদের কাছে/ আজ চাঁদ এসেছে আমার জানালার কাছে/ স্ফটিক চাঁদের আলো আমাকে ঘিরেছে।/ চন্দ্রালোকিত রাতের ঐশ্বর্যময় বর্ণাঢ্য শোভায়/ ইচ্ছেরা সব উড়তে দেখি, উচ্ছল উল্লম্ফন।/ হৃদয় জুড়ে ভালোবাসার প্রস্ফুটন।’
নিরাশার পৃথিবীতে কবিরা শোনাতে চায় আশার বাণী। যেমনটি সাঈদ চৌধুরী শুনিয়েছেন তার ‘মেলবন্ধন’ কবিতায়।
’বহুকালের প্রতীক্ষা শেষে/ একটি সংবাদ এল আজ/ গ্রীষ্মের ঝরঝরে বাতাসে/ হৃদয়ে পরিতৃপ্তির আস্বাদ!/ খবরটির জন্য স্মৃতিমগ্ন/ প্রহর গুনেছি, বছর বছর/ জোৎস্নারাতে মন ছুঁয়েছে/ অলৌকিক আলোর বহর।/ আমরা যাকে প্রকৃতি বলি/ মায়ের মত, কল্যাণী পৃথিবী/ সেতো মহিমাময় জগৎস্রষ্টা/ এ জীবন ও মন তারই সৃষ্টি।/ ঝমঝম করে ঝড়েছে বৃষ্টি/ বিজলি চমকেও রেখেছি দৃষ্টি/ মুমিন কখনো হতাশ হয় না/ লা-তাকনাতু মির রাহমাতিল্লা।/ জড়ের বৃষ্টি শেষে রৌদ্রস্নাত/ সুরভী আমায় আবার খুজেছে/ সাধনার ফসল অমৃত, সহজে/ আসেনা, কিন্তু ঠকায়না কারো।’
বহু বিচিত্র বোধের কবি সাঈদ চৌধুরী। লিখেছেন নবীশ্রেষ্ঠ মুহাম্মদ সা. এর নবুয়ত প্রাপ্তির ঘটনা নিয়ে। সুদ, ঘুষ, ঈদ, রোযা বিলাতের জীবনচিত্র, আমাদের কষ্টার্জিত স্বাধীনতা, মাতাপিতা, মাফিয়াচক্রের উৎপাত এসব নিয়ে লিখেছেন। এমনকি গোলক রাজনীতির ভোজভাজির দিকেও আছে তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। এরদোয়ানের মতো বিশ্ববরেণ্য নেতার দুঃসাহসী গঠনমূলক কর্মকাণ্ডের প্রতি তিনি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল। তাঁর কবিতায় এমন বক্তব্য ফুটে উঠেছে।
কবিরা মূলত রচনা করেন মানুষের জীবনসংগীত। গীতলতাবিহিন কবিতা সার্থক কবিতা নয়। সাঈদ চৌধুরী কবিতা লিখতে লিখতে মাঝে মধ্যে ঢলে পড়েন সংগীতের কোলো। মশিউর রহমান কর্তৃক তাঁর খোদাপ্রেমের সংগীত শুনে মনে হয় তিনি ইসলামি ভাবধারার কবি। প্রতিবন্ধী শিশুদের নিয়ে রচিত, তারকাশিল্পী ফাহিম ফয়সাল কর্তৃক পরিবেশিত সংগীত শুনে মনে হয় তিনি মানবতার মহান কবি।
জয়তু সাঈদ চৌধুরী। আপনার কলম আরো শানিত হোক আগামীদিনের বাংলা সাহিত্যের খেদমতে।
লেখক: অধ্যাপক, কবি ও সাহিত্য সমালোচক