লিলুয়া হয়ে মেইন লাইনের ট্রেন হাওড়া ঢুকছে। দুপুর বারোটা হবে। পেট ভর্তি শরীরের প্রসন্ন দ্যুতি মুখে সকলে চলেছেন নিজের নিজের কাজে। এরই মধ্যে কানে ভেসে আসলো খটখট আওয়াজ সঙ্গে ভাঙা অপরিণত গলায় গান। গানের কলিটা অনেকটা এরকম “ম্যায় তো তন্দুরী মুরগী হু ইয়ার/গাটকালে সাইয়া অ্যালকোহল সে”- অর্থাৎ আমি তন্দুরী মুরগী, প্রিয় তুমি আমায় মদ সহযোগে ভক্ষণ করো।” সম্ভবত বিলাসব্যসনে থাকা কোনো অভিনেত্রীর ফিল্মের গান। সেই গানই গাইছে দশ থেকে এগারো বছরের একটি মেয়ে।
দুটো ইঁটের টুকরোকে ঠুকে ঠুকে যে খটখট শব্দ তারই সঙ্গে সুর মিলিয়েছে বাচ্চাটি। জটপাকা উস্কোখুস্কো ময়লা চুল, ছেঁড়া জামা আর একটা এনামেল বাটি নিয়ে সে এই ট্রেনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যে বয়সে স্বপ্নের ফুল দিয়ে মালা গাঁথে শৈশব সে বয়সে যদি খিদের জন্য পেট জ্বলে তখন অসহায়তার রূপ এরকমই হয়! বিস্ময়টা অন্য জায়গায়, যেখানে অভাব আর খিদে খাদ্যের বদলে অন্য কোনো উৎস খুঁজে নেয় সেখানে। মেয়েটি হয়তো ঐ সিনেমা দেখে ঐ গানের কলি আর তার ভঙ্গি কিছু আয়ত্তে এনেছে। ভেবেছে এই চকচকে গানের অংশ হয়ে সেও দু’একটা টাকা পাবে। তাই এই নাচ দেখিয়ে দেখিয়ে সে টাকা জোগাড়ে ব্যস্ত।
তার সঙ্গে তার ছোট্ট একটি ভাই। সেও কোমর দুলিয়ে নাচছে আর হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে।যেন অসহায় দুটো বনফুলের ওপর রাজ্যের ধুলো এসে জমেছে। কিছু পরে যখন ট্রেন প্রায় হাওড়া স্টেশনে ঢুকে এসেছে তারা ভিক্ষার কাজ থেকে বিরতি নিল। ক’টা টাকা ঐ বাচ্চা মেয়েটার হাতে দিয়েছিলাম। দেখলাম ভিক্ষার টাকা নিয়ে ওদের আরো অনেকের মধ্যে একটা বিরোধ বাঁধল, তারপর একটা লম্বা মতো লোক এসে টাকা কেড়ে নিল। ছোট্ট ছেলেমেয়ে দুটো গালাগালি জানে। অজস্র বিপরীত অবস্থায় এই গালাগালি সম্বল জেনে বোধ হয় তারা শিখে গেছে। ওরা গালাগালি করল তবু লোকটা টাকা নিয়ে চলে গেল। তারপর যে দৃশ্য দেখেছিলাম সেটা কেবল অভাব, খিদেতে আটকে ছিল না। পথ হারিয়ে সেই খিদে কোথায় এসে দাঁড়িয়েছিল ভাবতে ভয় করে।
বাচ্চা ছেলেটি ট্রেনেই একটা কোণে বসে পড়ল, পকেট থেকে বার করল একটা টিউব। যা থেকে বেরিয়ে আসছে ডেন্ডাইট। প্রাণ ভরে তার গন্ধ নিচ্ছিল শিশুটি। তার হাত থেকে মাঝে মাঝে কেড়ে নিচ্ছিল তার দিদিও। তারা দুজনেই পা ছড়িয়ে আচ্ছন্নের মতো পড়েছিল। এই ডেন্ডাইটের ঘোরে আসক্ত হয়ে কোনো এক ঘোরে তারা নিজেদের জীবনের সবচেয়ে যন্ত্রণাময় খিদেটাকে এক ঝটকায় ঝেড়ে ফেলতে শিখে গেছে। যেটুকু টাকা ওরা ভাইবোন ঐ বিসদৃশ গান গেয়ে অর্জন করেছিল তাও কেড়ে নিয়ে গেছে কেউ। ডেন্ডাইট ছাড়া ওদের উপায় কী ছিল! কিছু কি ছিল না, হয়তো ছিল! তবে যখন এই দেহ খাদ্যের অভাবে কেবলই একটি জীবের প্রাণ হিসেবে বেঁচে থাকে তাদের কাছে সত্যি কি কোনো পথ বা বিপথ কোনো ভালো বা মন্দের আর কোনো অস্তিত্ব থাকতে পারে!
আমাদের অজস্র আহা-উহু, ক্ষণিকের চোখের জল বাষ্পীভূত হয়ে উড়ে কোথায় চলে যায়। আর ক্রমাগত এক পেট খিদে নিয়ে বেঁচে থাকে অজস্র শৈশব। আমরা তার পাশ কাটিয়ে গন্তব্য খুঁজে ফিরি ভরাপেটে আর আমাদের সাদা ভাতের গন্ধ ওদের ডেন্ডাইটের গন্ধের কাছে প্রতিদিন হারতে থাকে।