আজ সোমবার (২৭ জানুয়ারি) ‘বৈদ্যের বাজার ট্র্যাজেডি’। ২০০৫ সালের এই দিনে গ্রেনেড হামলায় নিহত হন হবিগঞ্জ-লাখাই ৩ আসনের তৎকালীন সংসদ সদস্য সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া। ওই হামলায় শাহ এএমএস কিবরিয়ার ভাতিজা শাহ মনজুরুল হুদাসহ প্রাণ হারান আরও ৪ জন। এতে আহত হন কমপক্ষে শতাধিক নেতাকর্মী।
কিন্তু দীর্ঘ ১৫ বছরেও ভয়াবহ এই হত্যাকাণ্ডের বিচার কাজ সম্পন্ন হয়নি। সিলেট দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে মামলাটি স্থানান্তরের পরও ঘটনার ১৫ বছরে ১৭১ সাক্ষীর মধ্যে মাত্র ৪৩ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ সম্পন্ন হয়ছে।
মামলার এমন ধীরগতির কারণে বিচার নিয়ে চরম হতাশা ও ক্ষোভ বিরাজ করছে নিহতদের পরিবারসহ জেলাবাসীর মধ্যে।
ফিরে দেখা বৈদ্যের বাজার ট্র্যাজেডি
২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি বিকেলে হবিগঞ্জ সদর উপজেলার বৈদ্যের বাজারে ঈদ পরবর্তী এক জনসভায় প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দেন তৎকালীন হবিগঞ্জ-৩ আসনের এমপি ও সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ্ এএমএস কিবরিয়া। সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে জনসভা থেকে ফেরার পথে তাকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড ছোড়ে দূর্বৃত্তরা। সেই গ্রেনেডের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হন শাহ্ এএমএস কিবরিয়াসহ অনেক নেতাকর্মী। স্থানীয় লোকজন কিবরিয়াসহ আহতদের উদ্ধার করে হবিগঞ্জ সদর আধুনিক হাসপাতালে নেন। শাহ এএমএস কিবরিয়া ও তৎকালীন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মো. আবু জাহিরের রক্তক্ষরণ কোনভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছিল না। এ সময় দ্রুত হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করতে না পেরে অ্যাম্বুলেন্সে করেই কিবরিয়া ও আবু জাহিরসহ অন্যান্য আহতদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। ঢাকা যাওয়ার পথে রাস্তায় শাহ এএসএম কিবরিয়া মৃত্যুবরণ করেন।
কিবরিয়া হত্যার বিচার কার্য
এ ঘটনায় রাতেই হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবদুল মজিদ খান বাদী হয়ে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দু’টি মামলা দায়ের করেন। মামলার তদন্তে কাজ করে দেশী-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা। কিন্তু মামলাটির স্বাভাবিক তদন্ত না হয়ে দলীয় বিবেচনায় পরিচালিত হতে থাকে।
২০০৫ সালের ২০ মার্চ সিআইডি’র তৎকালীন সহকারী পুলিশ সুপার মুন্সি আতিকুর রহমান মামলাটি তদন্ত করে ১০ জনের বিরুদ্ধে ১ম অভিযোগপত্র দাখিল করেন। অভিযোগপত্র দেয়ার পর মামলার বাদী অ্যাডভোকেট আবদুল মজিদ খান ২০০৬ সালের ৩ মে সিলেট দ্রুত বিচার আদালতে নারাজি আবেদন করেন। আদালত তার আবেদন খারিজ করলে ১৪ মে তিনি হাইকোর্টে আপিল করেন। আপিলের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ সরকারের প্রতি ‘কেন অধিকতর তদন্ত করা যাবে না’ মর্মে রুল জারি করেন। এই রুলের বিরুদ্ধে ২০০৬ সালের ১৮ মে লিভ টু আপিল করে সরকার। আপিল বিভাগ সরকারের আপিল খারিজ করেন।
এরপর ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর এ মামলার অধিকতর তদন্ত শুরু হয়। দায়িত্ব দেয়া হয় সিআইডি’র সহকারী পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলামকে। দীর্ঘ তদন্ত শেষে তিনি ২০১১ সালের ২০ জুন আরও ১৪ জনকে আসামি করে এই আলোচিত মামলার অধিকতর তদন্তের অভিযোগপত্র দাখিল করেন। কিবরিয়া হত্যাকাণ্ডের সাড়ে ৬ বছর পর লুৎফুজ্জামান বাবর, মুফতি হান্নানসহ ২৪ জনকে আসামি করে অধিকতর তদন্তের অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছিল।
এরপর নানা নাটকীয়তার পর তৎকালীন সিআইডির এএসপি মেহেরুন নেছা দীর্ঘ তদন্ত শেষে সাড়ে ৯ বছর পর ২০১৪ সালের ১৩ নভেম্বর হবিগঞ্জের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রোকেয়া আক্তারের আদালতে নতুন ১১ জনকে অন্তর্ভূক্ত করে ৩৫ জনের বিরুদ্ধে ৩য় সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করেন।
অন্তর্ভূক্ত আসামিরা হলেন- সিলেট সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, হবিগঞ্জ পৌরসভার সাবেক মেয়র জি কে গউছ, বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক উপদেষ্টা হারিছ চৌধুরী, মুফতি আব্দুল হাই, মুফতি তাজ উদ্দিন, মুফতি সফিকুর রহমান, মোহাম্মদ আলী, বদরুল, মহিবুর রহমান, কাজল আহমেদ, হাফেজ ইয়াহিয়া। একই সাথে পূর্বের চার্জশিটভূক্ত ইউসুফ বিন শরীফ, আবু বক্কর আব্দুল করিম ও মরহুম আহছান উল্লাহকে চার্জশিট থেকে অব্যাহতির আবেদন করেন।
এরপর ২০১৫ সালের জুনে মামলাটি সিলেট দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে হস্তান্তর করা হয়। এরপর থেকে সেখানে বিচার কার্য শুরু হয়। বর্তমানে চলছে সাক্ষ্যগ্রহণ।
বিচার নিয়ে নিহতদের পরিবারের হতাশা
১৫ বছরেও জঘন্যতম এই হত্যাকাণ্ডের বিচার আলোমুখ দেখেনি। বিষয়টি নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছে নিহতের পরিবার। পাশাপাশি একই আর্তনাদ আহতদের। শাহ্ এএমএস কিবরিয়ার পরিবারের দাবি তার হত্যাকাণ্ড নিয়ে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার রাজনীতি করছে। সুষ্ঠু তদন্তের নামে ভূয়া চার্জশিট প্রদান করা হয়েছে আদালতে। এই চার্জশিট বাতিল করে পুনরায় তদন্ত করে সঠিক চার্জশিট প্রদানের মাধ্যমে দ্রুত বিচার কার্য সম্পন্ন করার দাবি তাদের। শুধু শাহ্ এএমএস কিবরিয়ার পরিবারই নয়, বিচার পাওয়ার আশায় বুক বেঁধে আছেন নিহত সিদ্দীক আলী ও আব্দুর রহিমের পরিবারও।
এ ব্যাপারে নিহত সিদ্দীক আলীর স্ত্রী ছুরতা বানু বলেন- ‘বিচার হইব হইব শুনতে শুনতে ১৫ বছর হইয়া গেছে। কিন্তু আমরা বিচার পাইতেছি না। জীবিত থাকতে যদি স্বামীর বিচার দেখে যেতে না পারি তাহলে মরলে কি বিচার পাব?’
নিহত আব্দুর রহিমের মেয়ে লিজা আক্তার বলেন- ‘আমি যখন ছোট ছিলাম তখন আমার বাবা গ্রেনেড হামলায় মারা গেছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমরা কোন বিচার পাইনি। বাবা মারা যাওয়ার পর আওয়ামী লীগ নেতারা ভুলেও আমাদের দেখতে আসেন না।’
এ ব্যাপারে শাহ্ এএমএস কিবরিয়ার ছেলে গণফোরামের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ড. রেজা কিবরিয়া বলেন- ‘আমার বাবার হত্যাকাণ্ড দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার রাজনীতি করছে। দীর্ঘ ১৫ বছরেও আমরা পিতা হত্যার বিচার পাইনি। আমার মা বিচারের আশায় থাকতে থাকতে মারা গেছেন।’
তিনি বলেন- ‘হত্যাকাণ্ড নিয়ে আদালতে সে চার্জশিট দেয়া হয়েছে সেটি ভুয়া। আমরা সেটি মানি না। এই চার্জশিট বাতিল করে পুনরায় তদন্ত করে সঠিক চার্জশিট প্রদান করা হোক। অন্যথায় সুষ্ঠু বিচার আশা করা যায় না।’
মামলার বাদী হবিগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট আব্দুল মজিদ খান বলেন, ‘মূলত আইনি জটিলতার কারণেই বিচার কাজ বিলম্বিত হচ্ছে। যদিও সরকার চায় বিচার কাজ দ্রুত নিষ্পত্তি হউক।’
তিনি বলেন, ‘এ মামলার প্রায় সকল আসামিই অন্য আরও ৫/৭টি মামলার আসামি। একই তারিখে দেশের বিভিন্ন আদালতে অন্য মামলারও হাজিরা থাকে তাদের। তাছাড়া তারা প্রায়ই অসুস্থ্য থাকেন। যে কারণে তাদের উপস্থিতি ছাড়া সাক্ষ্যগ্রহণ সম্ভব হয় না। তবে আমি আশাবাদী সকল জটিলতা কাটিয়ে অতি দ্রুতই বিচার কাজ সম্পন্ন হবে।’