রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি মেলেনি লাকসামের বেলতলী বধ্যভূমির

কুমিল্লা, দেশের খবর

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, কুমিল্লা | 2023-08-23 05:10:05

কুমিল্লার লাকসাম রেলওয়ে জংশনের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থান করা স্বাধীনতা যুদ্ধের বাহক বেলতলী বধ্যভূমি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে স্থাপিত বাংকার পাশে প্রায় ২ হাজার ফুট এলাকা নিয়ে রয়েছে বধ্যভূমিটি। একাত্তরের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনীর বর্বরতার দুঃসহ স্মৃতি বহন করে রয়েছে এটি। এখনও মাটি খুঁড়লেই বেরিয়ে আসে মানুষের হাড়-কংকাল। স্বাধীনতা যুদ্ধের বাহক হলেও, বিজয়ের ৪৮ বছর পরেও কোন প্রকার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায়নি বধ্যভূমিটি।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, যুদ্ধকালীন সময়ে এখানে বিভিন্ন বয়সের অন্তত ১০ হাজার বাঙ্গালী নারী-পুরুষকে নির্মম নির্যাতন শেষে হত্যার পর এখানেই মাটি চাপা দেওয়া হয়েছিলো।

স্বাধীনতার কয়েক দশক পরেও অযত্ন আর অবহেলায় পড়ে থাকার পর সর্বশেষ ২০১৫ সালে এ বধ্যভূমিটিতে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। তবে প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণ ও অবহেলায় এটি এখন দিনের বেলায় গো-চারণ ভূমি, আর রাতের বেলায় অপরাধীদের আখড়ায় পরিণত হয়েছে।

স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পাক হানাদার বাহিনী ১৯৭১ সালের ১৫ই এপ্রিল বৃহত্তর লাকসাম অঞ্চল দখল করে। তারা রেলওয়ে জংশনের পশ্চিম-দক্ষিণ পাশে অবস্থিত থ্রি এ সিগারেট ফ্যাক্টরিতে ক্যাম্প স্থাপন করে। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের পর যুদ্ধকালীন সময়ে পাকবাহিনী সিগারেট ফ্যাক্টরিটিকে মিনি ক্যান্টনমেন্ট হিসেবে ব্যবহার করতো। এ ক্যান্টনমেন্টের অধীনে ছিলো লাকসামসহ কুমিল্লা জেলার দক্ষিণে অবস্থান করা চাঁদপুর, ফেনী ও নোয়াখালী অঞ্চল। এসব অঞ্চল থেকে পাকবাহিনী শত শত যুবক-যুবতীসহ বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষকে ট্রাকে ভরে তুলে নিয়ে আসতো। এদের মধ্যে যুবতীদের উপর যৌন নিপীড়ন শেষে নির্মমভাবে হত্যা করে বেলতলীতে মাটি চাপা দেওয়া হতো। বিশেষ করে ফেনী, নোয়াখালী, চাঁদপুর এবং বরিশাল অঞ্চলের ট্রেনে আসা যাত্রীদের পাক সেনারা রেলওয়ে জংশন থেকে ধরে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সন্দেহে নির্যাতন চালিয়ে হত্যার পর ওখানেই মাটি চাপা দিতো।

বেলতলী বধ্যভূমি এখন গো-চারণ ভূমি, ছবি: বার্তা২৪.কম

যুদ্ধকালীন সময়ে লাকসাম রেলওয়ে জংশনের ঝাড়ুদার উপেন্দ্র মালি ও শ্রীধাম চন্দ্র দাস এসব ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। শ্রীধামের ভাষ্য, ৭১ এর ১৫ই এপ্রিল পাক হানাদার সেনারা লাকসাম আক্রমণের পরদিন জংশন প্লাটফর্মে বেশ কিছু বাঙ্গালীর লাশ বিক্ষিপ্তভাবে পড়েছিলো। তৎকালীন রেলওয়ে স্যানিটারি ইন্সপেক্টর আমাকে ডেকে নিয়ে লাশগুলো সরানোর আদেশ দেন। আমি নিজেই লাশগুলো রেলওয়ে জংশনের দক্ষিণ বেলতলীতে মাটি চাপা দেই। দু’দিন পর সেখানে দেখলাম পাক সেনারা হত্যা করলো রেলওয়ে জংশনের পাশে অবস্থিত মিশ্রি গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আবদুল খালেকসহ একদল বাঙ্গালীকে। ওই সময় আমি মুক্তিযোদ্ধা আবদুল খালেকের লাশ মাটি চাপা দেয়ার স্থানটিকে চিহ্নিত করে রাখি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সেখান থেকে লাশ তুলে তাদের পারিবারিক কবরস্থানে নেওয়ার ব্যবস্থা করি। ওই সময় সিগারেট ফ্যাক্টরির বিভিন্ন কক্ষে হানাদাররা আটক করে রাখতো শত শত বাঙ্গালী যুবতী মেয়েদের। তাদের ধর্ষণের পর নরপশুরা তাদের স্তন কেটে উল্লাস করে হত্যা করতো।

তিনি জানান, সারাদিন বেলতলী বাংকারের পাশে গর্ত খুঁড়ে রাখতাম। পরদিন সকালে সিগারেট ফ্যাক্টরিসহ অন্যান্য স্থান থেকে লাশ এনে এখানে মাটি চাপা দিতাম। সে সময়ের কথাগুলো মনে হলে রাতে ঘুম আসে না। নিজের জীবন এবং মা-বাবার জীবনের নিরাপত্তার জন্য বাধ্য হয়ে লাশ মাটি চাপা দেই। কতো লাশ দু’হাতে মাটি চাপা দিয়েছি তার হিসাব মেলাতে পারছি না।

লাকসাম পৌর শহরের রাজঘাট এলাকার খোরশেদ আলম জানান, তার বাবা সৈয়দ আনু মিয়া, মা বেলজান বিবি, ছোট ভাই মনু এবং দূর সম্পর্কের দাদা আবদুল জলিলকে পাক বাহিনী সিগারেট ফ্যাক্টরিতে ধরে নিয়ে যায়। সেখানে তাদেরকে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করে বেলতলী বধ্যভূমিতে মাটি চাপা দেয়।

স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা জানান, বধ্যভূমিটিতে লাকসাম রেলওয়ে জংশনের পার্শ্ববর্তী পাইকপাড়া গ্রামের তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা আবদুছ সোবাহান ও দরবেশ নূর ইসলাম নুরুকেও মাটি চাপা দেওয়া হয়েছিল।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৯৯ সালে ঢাকার একদল গবেষক ও সাংবাদিকের অনুরোধে শ্রীধাম দাস বেলতলী বধ্যভূমি খুঁড়ে বের করে আনেন বেশ কয়েকটি মাটি চাপা দেয়া মানুষের হাড় গোড়-কঙ্কাল-করোটি। এ সময় উদ্ধার করা বেশ ক’টি মাথার খুলি ও কিছু হাড় বর্তমানে ঢাকায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। এছাড়া ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ লাকসাম থানা কমান্ডের একটি আবেদনের প্রেক্ষিতে কুমিল্লা জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে লাকসাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে এই বধ্যভূমির জায়গাটি অধিগ্রহণের নির্দেশ প্রদান করে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়। কিন্তু এরপর ২০ বছর পার হলেও আজও তা কার্যকর হয়নি। এনিয়ে ক্ষোভের অন্ত নেই স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে।

লাকসাম উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবদুল বারী মজুমদারসহ অন্তত ৫ জন মুক্তিযোদ্ধা জানান, ২০০০ সালের দিকে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের পরিচালক আক্কু চৌধুরী জানিয়েছিলেন ইন্টারন্যাশনাল কোয়ালিশন অব হিস্টোরিক সাইট অব কনসেস এর সহায়তায় ওই বছর লাকসাম রেলওয়ে জংশনের বেলতলী, জয়পুরহাট ও বগুড়া এ তিনটি বধ্যভূমি খনন কাজ শুরু হবে। ওই সময় বেশ ক’জন বিশেষজ্ঞ ও সাংবাদিক এই বধ্যভূমির চিত্রও ধারণ করে নেন। কিন্তু এই পর্যন্ত আর কোন কাজ হয়নি।

এ সম্পর্কিত আরও খবর