নিজ পল্লীতে ফিরছেন সাঁওতালরা, তবে আতঙ্ক কাটেনি

গাইবান্ধা, দেশের খবর

গনেশ দাস,স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম, বগুড়া | 2023-08-30 23:15:33

সাহেবগঞ্জ (বাগদা) সাঁওতাল পল্লী থেকে: গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাহেবগঞ্জ সাঁওতাল পল্লী। ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে তিনজন আদিবাসী নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে উচ্ছেদ করা হয় আড়াই হাজার পরিবারকে। সেই সময় আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয় আদিবাসীদের ঘর-বাড়ি, গবাদিপশু এমনকি শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানও।

এরপর তারা পার্শ্ববর্তী জয়পুর ও মাদারপুর গ্রামে অন্যের জায়গায় আশ্রয় নেয় সাঁওতালরা। কিন্তু, গ্রামবাসী এখন আর ওই গ্রামে তাদের আশ্রয় দিতে চাচ্ছেন না। ফলে সাঁওতালরা আবারো ফিরছেন তাদের আদি নিবাস কুয়ামারা দিঘির পাড়ে। সেখানে তৈরি করছেন ঝুপড়ি ঘর। তবে এখনও কাটেনি সেই ভয়াবহ হামলার আতঙ্ক। দু:স্বপ্নের মতো আঘাত হানে দুর্বিষহ সেই স্মৃতি।  

একদিকে নিজ আবাসভূমিতে ঘর তৈরির পর থেকেই আসছে নানা ধরনের হুমকি। নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে সাঁওতালরা পালা করে তীর-ধুনক নিয়ে দিন-রাত পাহারা দিচ্ছেন তাদের পল্লী।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, রংপুর সুগার মিল ১৯৫৫-৫৬ সালে বাগদা ইক্ষু খামারের অধীনে ইক্ষু চাষের জন্য স্থানীয় আদিবাসী ও বাঙালিদের ১৮৪২ একর জমি লিজ নেয়। পরবর্তী সময়ে রংপুর সুগারমিল বন্ধ ঘোষণা করা হলে আখ চাষও বন্ধ হয়ে যায়। জমিগুলো পরিত্যক্ত থাকায় আদিবাসীরা সেগুলো চাষাবাদ শুরু করেন। এনিয়ে রংপুর সুগার মিল কর্তৃপক্ষ আপত্তি জানালে তাদের সঙ্গে যোগ দেয় স্থানীয় প্রভাবশালী মহল। ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর বিকেলে জমি দখল নিয়ে প্রভাবশালী মহলের ভাড়াটিয়া বাহিনীর সঙ্গে সংর্ঘষ বাধে আদিবাসীদের। আদিবাসীরা তীর ধনুক নিয়ে হামলাকারীদের মোকাবিলা করতে গেলে পুলিশের গুলিতে নিহত হন শ্যামল হেমব্রম, মঙ্গল মারান্ডি এবং রমেশ টুডু নামের তিন আদিবাসী। সংঘর্ষের এ ঘটনায় উভয়পক্ষের কমপক্ষে ৩০ জন আহত হন।

ওই সময়ই আদিবাসী পল্লীতে আগুন দিয়ে ঘরবাড়ি পুড়িয়ে তাদেরকে উচ্ছেদ করা হয়। উচ্ছেদ হওয়া পরিবারগুলো আশ্রয় নেন পাশের গ্রামে। প্রায় তিন বছর উদ্বাস্তেুর মতো কাটে তাদের জীবন। এখন তারা ফিরতে শুরু করেছেন পূর্বের সেই সাঁওতাল পল্লী ১৬ একর আয়তনের কুয়ামারা দিঘির পাড়ে। নতুন করে ঘর তুলতে শুরু করেছেন সেখানে। তবে তারা চরম আতঙ্কে রয়েছেন। কেননা ঘর তোলার পর থেকেই আসছে নানা ধরনের হুমকি-ধামকি। আশঙ্কা করছেন যে কোন সময় তাদের ওপর হামলা হতে পারে। একারণে পুরুষ সদস্যরা তীর ধনুক নিয়ে দিন-রাত পালাক্রমে পাহারা দিচ্ছেন সাঁওতাল পল্লী।

সাঁওতাল পল্লীর বাসিন্দা রমেন সরেন, কল্পনা মর্ম, মিকাই মর্ম, ভগন মর্ম বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে বলেন, এই সম্পত্তি তাদের পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া। সম্পত্তি উদ্ধার করতে গিয়ে তাদের তিনজন জীবন দিয়েছেন। সম্পত্তি রক্ষা এবং নিজেদের আত্মরক্ষার জন্য তারা সব সময় তীর-ধুনক নিয়ে পাহারা দিচ্ছেন। হামলাকারীদের মোকাবিলা করতে তীর-ধনুকই তাদের মূল হাতিয়ার।

২০১৬ সালে তিনজন আদিবাসী নিহত হওয়ার পর গড়ে তোলা হয়েছে সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটি। এই কমিটির সদস্যরাই সাঁওতালদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছেন।

সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির অন্যতম সদস্য থোমাস হেমব্রম বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে বলেন, কুয়ামারা দিঘির পাড়ে সাঁওতাল পরিবারগুলো নতুন করে ঘর তুলছে। এ খবর পেয়ে চলতি মাসের ১৫ তারিখে প্রশাসনের কর্মকর্তারা পরিদর্শনে আসেন। এসময় সাঁওতালরা তীর-ধনুক নিয়ে অবস্থান নেয়। এমন অবস্থা দেখে যারা পরিদর্শন করতে এসেছিলেন তারা ফিরে যান।

তিনি বলেন, সাঁওতালরা চরম আতঙ্কে রয়েছেন। আর তাই ওইদিন তারা তীর-ধনুক নিয়ে অবস্থান নিয়েছিলো। সাঁওতালদের নিরাপত্তা এবং সেইদিনের বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে সংগ্রাম কমিটির নেতাদের একটি প্রতিনিধি দল গাইবান্ধা জেলা প্রশাসকের সঙ্গে বুধবার (১৬ অক্টোবর) দেখা করতে গেছেন।

এ সম্পর্কিত আরও খবর