গ্রামের প্রবেশপথের দুই পাশে সারি সারি তুলশি ও বাসক গাছ। একটু এগোলেই বাড়ির আনাচে কানাচে চোখে পড়বে বিভিন্ন আকৃতির লতাপাতার গাছ। বাড়ির আঙিনা বা উঠান বলতে কোনো ফাঁকা জায়গা নেই, যেদিকে চোখ যায় শুধু গাছ আর গাছ।
লতাপাতা বা কোনো আগাছা নয়, সবই ঔষধি গাছ। এখানেই শেষ নয় গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে গেলে দেখা যাবে বিলুপ্ত প্রায় অশোক, চিরতা, কর্পুর, পুনর্বভা, তেজবল, নাগেশ্বর, অশ্বগন্ধা, জাতিপুষ্প, গোরখ চাকুলিয়া, কূটরাজ গাছ। এছাড়াও জীবন রক্ষাকারী মহৌষধ হিসেবে পরিচিত তুলশি পাতা, বাসক পাতা, কলোমেঘ, ওলট কম্বল, হরতকি, বহেরা, অর্জুন, স্বর্ণলতা, তেজপাতা ও বস গাছ।
এমন দৃশ্য দেখা যায় রংপুরের পীরগাছা উপজেলার পেটভাতা গ্রাম ঘুরে। গ্রামের ষাটোর্ধ্ব জব্বার-সালেহা দম্পতির উদ্যোগে পেটভাতা গ্রামটির চিত্রই পাল্টে গেছে। গ্রামটি এখন ঔষধি গ্রাম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
এলাকায় কবিরাজ হিসেবে পরিচিত আব্দুল জব্বার ২০০২ সালে নিজের প্রয়োজনে স্বল্প পরিসরে বাড়ির আশে পাশে ঔষধি গাছ লাগান। পরে তিনি বিভিন্ন এনজিও’র মাধ্যমে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে এলাকার দরিদ্র কৃষকদের বাড়ির আঙিনা বা উঠানে পরিত্যক্ত জমিতে ঔষধি গাছ চাষ করে স্বাবলম্বি হওয়ার স্বপ্ন দেখান।
শুরুতে এলাকার ১২ থেকে ১৫ জন কৃষকের মাঝে আব্দুল জব্বার নিজ উদ্যোগে চারা সংগ্রহ করে বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে লাগিয়ে দেন। একই সাথে পরিচর্যাও করতে হয়েছে তাকে। পরে এক বছরের মাথায় ঐ কৃষকদের বাড়িতে লাগানো ঔষধি গাছ থেকে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় হয়।
বর্তমানে গ্রামটিতে প্রায় ৩০০ কৃষক ঔষধি গাছ লাগিয়ে প্রতি মাসে দুই থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করছেন। আব্দুল জব্বার-সালেহা দম্পতি নিজেরাই এলাকার কৃষকদের নিকট থেকে ঔষধি গাছ ও পাতা ক্রয় করে থাকেন। ক্রয়কৃত গাছ ও পাতা তারা প্রক্রিয়াজাত করে একাধিক ঔষধ কোম্পানি নিকট বিক্রি করে থাকেন। এ থেকে আব্দুল জব্বার-সালেহা দম্পতি প্রতি মাসে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা আয় হয়।
সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, বর্তমানে গ্রামটি চিকিৎসকবিহীন গ্রাম হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। গ্রামের লোকজন অসুস্থ হলে প্রাথমিক চিকিৎসা হিসেবে ঔষধি গাছ ব্যবহার করে থাকে। প্রতিটি বাড়ির লোকজন অধিকাংশ ঔষধি গাছের গুণাগুণ বলতে পারে।
পেটভাতা গ্রামের আয়শা বেগম বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম-কে বলেন, ‘পাঁচ শতক জমির উপর আমার বাড়ি। এখানে বসবাসের পাশাপাশি ঔষধি গাছ লাগিয়েছি। প্রতি মাসে ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকা পর্যন্ত ঔষধি গাছ ও পাতা বিক্রি করে থাকি। এটা আমাদের বাড়তি আয়।’
সলেমান মিয়া বলেন, ‘ঔষধি গাছ লাগিয়ে প্রতিমাসে ভালই আয় হয়। ঔষধি গাছের জন্য আলাদা খরচ করতে হয় না। শুধু পরিচর্যা করলে আয় করা সম্ভব।’
সফল উদ্যোক্তা ও কবিরাজ হিসেবে পরিচিত আব্দুল জব্বার মিয়া বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম-কে তার সফলতার কথা তুলে ধরে বলেন, ‘ইচ্ছা ছিল গ্রামটিকে ঔষধি গ্রাম বানাব। আমার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে।’
তিনি জানান, প্রতি মাসে বিভিন্ন জাতের ঔষধি গাছ ও পাতা ১০ থেকে ১৫ মণ ক্রয় করেন তিনি। এর মধ্যে শতমূল- ৬০ টাকা কেজি, তুলশি পাতা ৫০, বাসক পাতা ৪২, কলোমেঘ ১২০, ওলট কম্বল, হরতকি ৪০০ টাকা মণ, এছাড়াও বহেরা, অর্জুন, স্বর্ণলতা, তেজপাতা ও বস এসবের বাজার উঠা নামা করে থাকে। আয়ুর্বেদিক ওষুধ তৈরির কাঁচামাল হিসেবে বিভিন্ন ঔষধ কোম্পানির নিকট সরবরাহ করে থাকেন।
সংশ্লিষ্ট এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান মন্ডল বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম-কে বলেন, ‘এই গ্রামে বহু প্রজাতির ঔষধি গাছ আছে। এর মাধ্যমে হারিয়ে যেতে বসা ঔষধি গাছের সুরক্ষা হচ্ছে। এই ঔষধি গাছের বাগানের মাধ্যমে ভুক্তভোগীরা উপকৃত হচ্ছে।’